Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ অঝোর শ্রাবণে দেহ ছেড়ে দিতে দেখেছি কোনো কোনো কবিকে। বৃষ্টির কাছে কবির এই সহজাত সমর্পণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো। এ কি অবচেতনে ডুবন্ত এক সহোদর, নাকি পরম্পরায় জিইয়ে রাখা অমোঘ কোনো নাড়ির বন্ধন? উপযুক্ত রজনী পেলে ঘুমন্ত বীজ যেমন আপনিতেই জেগে ওঠে, গর্ভবতী হয়, তারপর কোনো ঘোর লাগা বর্ষায় ডালপালা মেলে দিয়ে আহ্লাদি হয়ে ওঠে মর্জিমতো, কবির রক্তেও তেমন কোনো স্বপ্নবীজ ছিল নাকি এতকাল!

ঘষে-মেজে ডাক্তার-কবিরাজ বানানো যায়, কিন্তু কবি? কবির জন্য আছে নাকি কোনো বাল্যশিক্ষা! উলটো উচ্ছনে যাবার ভয়ে কবি বানানোর চেষ্টা নেই কারো, নেই কোনো বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়। তা হলে! একদিন বরং সহজাত আত্মদর্শনেই চমকে ওঠেন কবি। নিজের ভাস্কর্যের ভিতরেই আবিস্কার করে ফেলেন স্বয়ং সদানন্দকে। তারপর লজ্জার আড়াল তোলার আগেই সবকিছু হতে দেখে ফেলে তাঁকে—প্রকৃতি, বিষাদ কিংবা আনন্দ। তিনি সহজভাবেই হয়ে যান দেওয়ানা মাস্তান, হয়ে যান বোহেমিয়ান এক প্রেমিক। তারপর কেবলই খোঁজাখুঁজি। সহজানন্দেরও মৌসুম থাকে। ধরনা দিতে দিতে উন্মাতাল কবি একসময় তাই মৌসুম বুঝে কানেকশান পেয়ে যান। তখন আর চেয়ে দেখতে হয় না। কবির দেহনদীতে শব্দরাজি যেন ঝাঁক ঝাঁক ইলিশ হয়ে ‘ঢেউ’ খেলাতে শুরু করে দেয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাজিল হতে থাকে সবকিছু। কেউ তাঁর হাত ধরে, অস্থির মমতায় তুলে দেয় কাগজ-কলম। তারপর কবির উদ্ভ্রান্ত মুখকে অগ্রাহ্য করে অঝোর শব্দধারায় ভিজতে ভিজতে তিনি লিখে ফেলেন ঝরঝরে সরল এক মহানামা। কবির নিজের আর কিছু করার থাকে না, তিনি কোনো এক মায়াবী পঙিক্তর পেছনে বড়জোর একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন হয়ে যান মাত্র।

সেজন্যেই কি হর-বর্ষায় কবির কবজিজুড়ে শ্রাবণ নামে? অথবা বৃষ্টি নামের গভীর ধারাপাতের ভিতর আপনাকে হারিয়ে ফেলেন তিনি? বিষয়শূন্য কবি তখন হয়তো দারুণ এক জপকারী। বৃষ্টিদানা তাঁর কাছে হয়ে যায় তসবিদানা! নাকি সৃষ্টির কৌশলে-কৌশলে তিনি নিরীক্ষণ করতে থাকেন মহাকৌশলীর আনন্দ কারখানা! তিনি তবে কি শ্রেষ্ঠ প্রশংসাকারী! স্রষ্টার বিনীত অনুবাদক! একে কী বলা যায়! এ কি প্রার্থনা নয়! কে পারে কবির মতো প্রকৃতির অমন গভীর ভাঁজ খুলে সুন্দর সংগ্রহ করতে! স্রষ্টাই কি বেশি খুশি হবেন না! যখন তাঁর প্রস্তুতকৃত সৃষ্টির অপরূপে মুগ্ধ কেউ সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ তর্জমা করতে নিজেকে নিয়োজিত করেন সম্পূর্ণ অবৈতনিক ইচ্ছায়!

…অগত্যা কবি ভিজে ভিজে জ্বরে পড়েন। সর্দি-কাশিতে ভোগেন। ভোগ-উপভোগের পরে এরকম একটা ভোগান্তি অবশ্য আসতেই পারে! কিন্তু পৃথিবীর পিরিচে জল পড়লে কবির এত দায় কেন! দূর গাঁয়ে বৃষ্টি হলে তাঁর চিরুনি করা শরীরে উসকোখুসকো খদ্দর নামে। বৃষ্টিকে নাগালে না পেয়ে হয়তো টলটলে বিস্বাদ বেয়ে নামে তাঁর নোনা জিহ্বায়। ঠোঁটের কাছে কি নেমে আসে অভিমানের পেয়ালা!

সামান্য দুটো পঙিক্তর আশায় তিনি বসে থাকেন অকাল নদীর শিথানে। তাঁর চোখের সামনে তখন খুলে যায় নিগূঢ় এক বারামখানা। নদী হয়তো থাকে না, হয়ে যায় কাজলমাখা গোলাপি রমণী। কবি দেখতে পান সম্মুখে চোখে চোখ রেখে শাঁখা পরে শুয়ে আছে আলুথালু ক্লান্ত নদী। মুহূর্তেই জলের ওপর শুরু হয় জলের কারুকাজ। তিনি তখন অন্য কেউ। অথবা মার্জিত শামুক যেমন গুটিগুটি পায়ে তলপেট ধরে আরো গহিনে যেতে থাকে, অথবা হয়তো পাশ দিয়ে হেঁটে যায় একদল সবুজ পাঞ্জাবি—এ কি ভূতগ্রস্থতা নয়! তখন তিনি কী করে আর বয়স লুকোতে পারেন? অতীতের শরবতে নামতে নামতে তিনি তাই হয়ে যান মেঘবালক। অথচ এসব রূপ-অপরূপের খেলায় কবির এতটুকু হাত থাকে না। তিনি বরং বাধ্য বালকের মতোই কোনো নস্টালজিক মহাসংগীতে অজস্র শ্রোতামণ্ডলীর সঙ্গে অসীম আলোতে চোখ রাখেন, গলা মেলান—যার সামনে খুলে যায় জঙ্গলের দরজা, খুলে যায় অবারিত সুদূর। নিজ থেকে কীই-বা করার থাকে তার!তবে কি কবিকে অনুবাদকের নিয়োগপত্র দিয়েই পাঠানো হয়েছিল! তাহলে নিস্কর্মা বলে এত অভিযোগ কেন, ধর্মে-সংসারে-সমাজে।

কোনো বৈশাখ, কোনো ফাগুন ফুলহীন-পাতাহীন হলে মেঘাচ্ছন্ন অভাবী বিকেলের মতো হয়ে যান কবি। শোকর্যালিতে তখন কবি ছাড়া আর কেউ থাকেন না। কেন! গাছগাছালির এত মৈথুন কবিকে নিয়ে? ফুল ঝরে গেলে কবির এত মায়া কেন! বেনামি পাখি নিহত হলে, পাখি নয় বরং কবির চল্লিশা হয়। ফুলের গন্ধে তিনি একলা জেগে থাকেন, ঘুমোতে পারেন না। কী করে ক্যালেন্ডারহীন বৃক্ষ জেনে যায় বসন্তকাল, খুঁজে নেয় অবারিত সঙ্গমকাল—ভাবনা কেবল কবির! আর কেউ কি নেই অনুবাদ করার? প্রকৃতির সত্যপাঠ শেষ হলে, তিনি থামেন না। তিনি আমাদের নাড়ি ধরেন, বুঝতে পারেন—আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে চলেছে।

অথচ কবির দিন চলে না, রাত চলে না। পেটে ঠিকমতো ভাত পড়ে না। কয়েকছত্র পঙিক্তর জন্য কবি আমৃত্যু হেঁটে চলেন, সাদা নুড়ি পাথর হয়ে তালু খুলে পড়ে থাকেন পথে পথে। নির্লজ্জ হাত পাতেন, বান্দারবানের গলিতে ঘুরতে ঘুরতে হয়ে যান পরম বৈষ্ণব। কেন? পঙিক্ত তো আর টাকা-পয়সা নয়! সংসারে পদ-পদবির দাম কী! সংসারে থাকে হা হা খাবারের মুখ। সেখানে হায়-হায় রবে হাভাতে জিকির ওঠে। সংসারে অসহযোগ-আগুন ঠেকাতে চরিত্রবান কবি অবশেষে প্রেমের অনলে ছারখার হয়ে যান। অ্যাকুরিয়ামের মাছের মতো তাঁর বুক ফাটে, মুখ ফোটে না। তবুও ক্ষমাহীন তরবারির নিচে কবির শিরকেই ধার্য করা হয় প্রতিবার! ওদিকে সমুদয় দায় তাচ্ছিল্য করে, জলে-জঙ্গলে উপর্যুপরি ঢেউ উড়ছে, চলছে কবির সঙ্গে সহস্র সহবাস, মচ্ছব। তাহলে?…কবি তো চায়ের দোকানে হাঙ্গামা করেন। বাকিতে একটা সাদা সিগারেট পেতে মূর্খের হাতে উপর্যুপরি অপমানিত হন। তিনি সবজি বিহীন আমিষশূন্য বাজার করে ফেরেন, তাঁর গৃহে জমা থাকে মন্দগুচ্ছ। কবি কি তাহলে জ্ঞানত ইচ্ছে করেই এসব উপেক্ষা করেন? অতঃপর পর্যুদস্তু হতে হতে জোছনার জমিনে জোব্বা পরা হরিণ হয়ে থপথপ করে হেঁটে চলেন। কাকে অনুবাদ করতে চান তিনি! মহাযোগের ভরা বানে ভাটফুলের ঝোপে ঝাঁক ঝাঁক জোনাকিরা বুদবুদ তুললে তিনি কেন বেসামাল হবেন! কার জন্য তাঁর এত তর্জমা-গীত-গজল। এত কেন তাঁর সুন্দর সন্ধান-কাব্যগাথা। কাকে খুঁজে পান তিনি পলাশ-বকুলের ভাঁজে ভাঁজে! তিনি কি দয়াময় ছাড়া অন্য কেউ? অথবা এসব কিছু আগ থেকে না ভেবেই তিনি সমাহিত হতে থাকেন ভাবনার কফিনে। তাতে কী! কথা তো একটাই থাকে—‘সাকারে সৃজন করলে ত্রিভুবন, আকারে চমত্কার ভাব দেখালে…কে বোঝে তোমার অপার লীলে’।

কবি তো নির্মোহ। তিনি ভোট করেন না, দলা পাকান না। তিনি বরং মানুষের প্রতি আরো নিবিড় করে নিষ্ঠাভাজন হয়ে গেয়ে ওঠেন—‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। তবুও কেন তাঁর নাম লেখা হচ্ছে বাতিলের খাতায়। হয়তো নিয়ম করে এবাদতখানায় যাওয়া হচ্ছে না তাঁর। কিন্তু যাঁর কবজিজুড়ে অবিচ্ছিন্ন শ্রাবণ, তিনি তো তসবি ভেবে দমে দমে জপ করেন বৃষ্টিদানা। ভাস্কর্যের আড়ালে ভাস্করকে খুঁজে পেতে যার এত বুক ভরা আকুলতা, তিনি তো অহর্নিশ এবাদতকারী। তিনি তো আকছার প্রেমিক, রূপ দেখেই পাগলা ফকির। কোথায় আছেন দয়াময়! কবির চেয়ে ভালো কে আবিস্কার করেছেন তাঁকে? কে আছে তাঁর মতো হাহাকারী—‘আমি কি তোমার কেহই নয়’। দয়াময় ছাড়া আর কাকেই বা ডাকতে পারেন তিনি? হয়তো জোছনার বরাত দিয়ে, ফুল-ফাগুলের বাহানা ধরে কিংবা কোনো জবরদস্ত মেঘের ছুতো তুলে তিনি ছাড়া কে ডাকেন তাঁকে অমন শিল্পভারে। নাম ধরে ডাকলেই ভালোবাসার ডিগ্রি পাওয়া যায় নাকি! তাহলে প্রভুভক্ত প্রাণীদের কী হবে! কী হবে সহজপ্রেমের তবে? এই যে ফাগুনময় ডাকাডাকি, ফুল পাখি প্রজাপতি, এই যে শ্রাবণময় গভীর জলপ্রপাত, ডালের চামড়ার তলে বসন্ত ছুঁয়ে দেখার জন্য উম্মুখ শাবক পাতাদের অস্থির কুচকাওয়াজ—কবি ছাড়া আর কে এসবে মনোনিবেশ করতে পারেন? গাছ মাছ নদী কিংবা মেঘেদেরও থাকে নিজস্ব মনোবেদনা। উটের গ্রীবায় জমাকৃত নীরবতারও আছে নিজস্ব বেদনাভার। তাহলে! অধিকন্তু কোনো এক অদ্ভুত আঁধারে যখন ঢেকে যায় চারদিক, নাস্তানাবুদ হতে হতে একমাত্র কবিই তখন মুখ তোলেন জোছনায়—বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে। তাহলে কবির পদবিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? বৃক্ষসকল যখন একযোগে এবাদতে নামে তখন কবির লোমগুলো হয়তো দাঁড়িয়ে যায়। কবি তখন বাধ্য হন বিবাগী হতে, পরম প্রার্থনাকারীর মতো তাঁর মর্মাহত দুই হাত কেবলই খুঁজে ফেরে তীর্থ মোকাম।…

কবিই তো সুপুরুষ, অভূতপূর্ব প্রেমিক। প্রেয়সীর মন শরীর জুড়ে তাঁর মতো আর কে পারে কাব্যশৃঙ্গার করতে। প্রিয়াকে মহিমান্বিত করতেই কেবল সত্যের সঙ্গে অকাতরে মিথ্যের মিশেল দিতে কার্পণ্য করেন না তিনি। এছাড়া সবখানে তিনি সত্যবাদী। অন্য সকলের দিকে আঙুল তোলার আগে তিনি নিজকেই আত্মসাবধান করেন—‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৫ মার্চ ২০২৩ /এমএম