বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আসন্ন ঈদুল আজহায় দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। ঈদে রাজধানী থেকে কমপক্ষে অর্ধকোটি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ঈদ উদযাপন করতে যাবেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তরাও রয়েছেন। যাদের মাধ্যমে দেশজুড়ে দ্রæত ছড়িয়ে পড়তে পারে এ রোগ। ফলে ঈদুল আজহার সময় ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রকট হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আমাদের চিন্তা ঈদের সময়টা নিয়ে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মীর ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জানা গেছে, ঈদুল আজহার সময় টানা বৃষ্টিপাত হলে অথবা কয়েকদিন রোদ থাকলে ডেঙ্গু বিস্তারের শঙ্কা নেই। বরং বর্তমান প্রকোপের মাত্রা কমে আসবে। কিন্তু যদি থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। তাছাড়া রাজধানীর মশা মারার প্রক্রিয়া নিয়ে দুই সিটি মেয়রের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধনের ওষুধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সরকার যে চারটি নতুন ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলোও জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে জানা গেছে।
ঈদে সারাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে কী ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট সবার ছুটি স্থগিত করা হয়েছে। সোসাইটি অব মেডিসিনের উদ্যোগে ১৩টি টিম দেশের বড় ১৩টি মেডিকেল কলেজে ডেঙ্গুবিষয়ক সায়েন্টিফিক সেমিনারের আয়োজন করেছে। সেমিনারগুলোতে মেডিকেল কলেজসহ আশপাশের সব জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকরা অংশগ্রহণ করবেন।স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ডাক্তাররা দিন-রাত কাজ করছেন। সার্বিক বিষয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে কাজ করছি। কিট, স্যালাইন, ডাক্তার, নার্সের অভাব নেই। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। তবে বিশেষ করে ঈদের সময়টা নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডাক্তার আয়েশা আক্তার জানান, ২৪ ঘণ্টায় ১৮৭০ জনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩৪ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩৯ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৯৭ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৫৫ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৩০ জন, বারডেম হাসপাতালে ১৩ জন, বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ২৬ জন, পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে ১৭ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮৩ জন, বিজিবি হাসপাতালে ৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৩৬ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসাপাতালে ১১৩ জন ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে ৪০৩ জন ডেঙ্গু রোগী। আর ঢাকা শহর ব্যতীত ৮ বিভাগের জেলাগুলোতে মোট ৮১৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত সর্বমোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৪ হাজার ৮০৪ জন। সরকারি হিসাবে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ জনে।
তবে বেসরকারি হিসাবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সর্বশেষ তথ্যমতে গতকাল রোববার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহাবুদ্দীন কোরেশির স্ত্রী সৈয়দা আখতার (৫৪) এবং জিগাতলার জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে শান্তা (২০) নামে এক তরুণী মারা যান।স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব বলছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ৩৯৮ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৭ হাজার ৩৮৮ জন। রাজধানীর বাইরে ঢাকা বিভাগের ১৪ জেলায় বর্তমানে মোট ভর্তি আছেন ৪৪৩ জন, গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২১৬ জন।
ডেঙ্গুর বিস্তার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শফি উল্লাহ মুন্সি বলেন, বাস, ট্রেন, লঞ্চে যাত্রার আগে মশা নিধন করা হবে না। ঈদের সময় অসংখ্য মানুষ বাড়িতে যাবে। তাদের সঙ্গেও ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর চিকিৎসকদের ডেঙ্গু বিষয়ে যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, সেটি ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই ঈদের সময় যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগটি ছড়াতে থাকবে, তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে প্রথম জেলা-উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।এদিকে সারাদেশে আসন্ন ঈদুল আজহায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কায় ঈদের ছুটিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢাকা না ছাড়ার আহŸান জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
গত ৩০ জুলাই সচিবালয়ে সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকের পর এ আহŸান জানানো হয়। এ ছাড়া বৈঠকে ডেঙ্গু চিকিৎসার সঙ্কট কাটাতে প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকদের ট্রেনিং বন্ধ করে কর্মস্থলে যোগ দেয়ারও নির্দেশনা দেয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কারের দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত সচিব শেখ মুজিবুর রহমান জানান, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থল ও আবাসিক এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি আসন্ন ঈদুল আজহার ছুটিতে ঢাকা না ছাড়তে ইতোমধ্যে তাদের প্রতি আহŸান জানানো হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ঈদের ছুটি একটি ধর্মীয় বিষয়। তবুও আমরা সব কর্মকর্তাকে ঈদের ছুটি ঢাকায় কাটানোর জন্য উৎসাহিত করছি। কোনো ক্ষেত্রে ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কারণ ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ঈদ উদযাপন করতে যাওয়াদের মধ্যে কেউ না কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত থাকতে পারেন। আর সেই থেকে পরিস্থিতি আরো প্রকট হতে পারে।
এ ছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের গ্রামের বাড়িতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। অনেক গ্রাম্য এলাকায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক থাকেন না। সেক্ষেত্রে সুচিকিৎসার অভাবে প্রাণহানির মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অধ্যাপক আজাদ বলেন, বর্তমানে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ অবস্থায় বাড়িতে না যাওয়াই ভালো। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার কামড় খেয়ে জ্বর নিয়ে কেউ গ্রামে গেলে এবং ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে গ্রামের মশা কামড়ালে সেই মশার মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমিত হয়ে অন্যরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সে কারণে জ্বর নিয়ে গ্রামে ঈদ করতে যাওয়াটা ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, আমরা বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসারত ডেঙ্গু রোগীদের বিষয়ে জানতে পেরেছি যে, বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে বাড়িতে গিয়ে ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। এ কারণেই আমরা আসন্ন ঈদে রাজধানীবাসী যাদের শরীরে জ্বর থাকবে তাদের গ্রামে ঈদ করতে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
এদিকে ডেঙ্গুর বিস্তার ও মশা এখন সারাদেশেই আতঙ্ক, আলোচনার ও উৎকণ্ঠার বিষয়। বিশেষজ্ঞরা যখন ডেঙ্গু মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তখন মশা নিধন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে এখনো একমত হতে পারেননি ঢাকার দুই মেয়র। ঢাকায় মশা নিধনে ব্যবহƒত ওষুধ কার্যকর না কি অকার্যকর, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে তাদের। এ ছাড়া বাড়ি বাড়ি মশার লার্ভা ধ্বংস, পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া, কতদিনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে তার ঘোষণা, মশা নিধনে বিশেষ সেল গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছেন সাঈদ খোকন ও আতিকুল ইসলাম।
তাছাড়া ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে ব্যবহƒত মশার ওষুধের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়ায় বিদেশ থেকে নতুন করে চারটি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু সরকার যে চারটি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলোও জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ, উঠেছে সে প্রশ্নও। ওষুধগুলো হচ্ছে, ম্যালাথিউন ৫৭% ইসি, ম্যালাথিউন ৫% আরএফইউ, ডেল্টামেথ্রিন + পিআরও -২% ইডবিøউ, প্রিমিফোস-মিথাইল ৫০% ইসি । বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নতুন যে চার ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার দুটি জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ না হওয়ায় ‘প্রত্যাহার’ করে নিয়েছে থাইল্যান্ড সরকার। আর একটি ওষুধ পরিবেশসম্মত না হওয়ায় একযুগ আগে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে। এ অবস্থায় নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়ছে দুই সিটি কর্পোরেশন। এ ছাড়া একটি ওষুধ নিয়ে বিতর্কের কথা জানিয়েছেন কীটতত্ত¡বিদরা।
জানা গেছে, বিপিএল লিমিটেড কোম্পানির ‘ম্যালাথিউন ৫৭% ইসি’ কীটনাশকটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বাতিল হওয়া কীটনাশকের তালিকায় রয়েছে। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলায় ২০০৭ সালের দিকে এর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে সংস্থাটি। এর সিরিয়াল নং এপি-৬৮। এর আগে ২০০৩ সালের দিকে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন মশা নিধনে এই ওষুধটি ব্যবহার করত।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ০৫ আগস্ট ২০১৯/ এমএম





