বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আমাদের এ দেশ অপরূপ দেশ। আমাদের আছে সবার থেকে আলাদা ছয়টি ঋতু। আর এই ছয়টি ঋতুর মধ্যে সুন্দর ঋতু বর্ষা। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস মিলে এই ঋতুটি দেশকে করে তোলে ছন্দময়। রাস্তাঘাট, নদীনালা, খালবিল, পুকুর ইত্যাদি ভরে উঠে থৈথৈ করা পানিতে। পানিতে বড় বড় ফোঁটা চিহ্নিত হয়ে মনোরম দৃশ্য তৈরি করে বর্ষার বৃষ্টি।
‘ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা কি ব্যাঙের ঘ্যাঙরঘ্যাঙ ডাক শুনেছো?’ উত্তর দিবে, ‘অবশ্যই শুনেছি।’ এই যে ঘ্যাঙরঘ্যাঙ ডাক তা কিন্তু বৃষ্টি ঋতুর। কত না মধুর লাগে এই ডাক শুনতে!
‘তোমরা কি কলার গাছের ভেলায় চড়ে বেরিয়েছ?’ বলবে, ‘বেরিয়েছি গ্রামের বাড়িতে।’ ভেলায় চড়ে বেড়াতে কতই আনন্দ তাই না! আর এই কলার গাছের ভেলা কিন্তু বৃষ্টির কাল বর্ষা ঋতুতেই পাওয়া যায়।
বন্ধুরা, তোমরা কি সাঁতার কেটেছ বানের জলে? মাছের ছুটে চলা দেখেছো কি নতুন জলে? কচুরিপানার গুচ্ছ কিংবা পালকে কি দেখেছো ভেসে বেড়াতে? কদমগাছের ডালে ফুটে থাকতে দেখেছো কি সুন্দর কদম ফুলকে? নিশ্চয় সাঁতার কেটেছ, দেখেছ মনের সুখে মাছের ছুটে চলা, শাদা-নীল রঙের কচুরিপানা ফুলসহ ভাটিরটানে ভেসে যাওয়া, কদম ফুলকে হাতে নিয়ে চোখ জুড়িয়েছিলে।
এসব দেখে ও উপভোগ করে নিশ্চয় তোমার মনে ছড়ার লাইন কেটে যায়। যেমন ঝুম বৃষ্টি দেখে তোমার কয়েকটি ছড়ার লাইন মুখে ফুটে উঠতে পারে,
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর
বৃষ্টি নামে মিষ্টি মধুর
বৃষ্টি পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়
জুঁই চামেলী ফুলের বোঁটায়
বাদলা দিনের একটানা সুর
বৃষ্টি নামে ঝুমুরঝুমুর।’’
ছোট্ট বন্ধুরা জানো কি এই ছড়াটি কে লিখেছেন? লিখেছেন মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ। তোমাদের মতো ছোট্টছোট্ট সোনামণিদের মনের কথা কীভাবে গুছিয়ে লিখেছেন তিনি ছড়ায়। মনে হয় যেন তোমাদের চোখ দিয়েই তিনি বৃষ্টি, বাদল, কদম, কেয়া ইত্যাদি দেখেছেন। আর সুন্দর কথার বুননে লিখেছেন ‘শ্রাবণের বৃষ্টি’ নামক ছড়াটি। এই বর্ষাকাল নিয়ে তোমাদের মনের কথাগুলো প্রিয় সেই কবি আরো নিখুঁতভাবে সাজিয়েছেন দেখ,
‘বৃষ্টি এলো কাঁশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথারে
লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
গাঁয়ের নামটি হাটখোলা
বৃষ্টিবাদল দেয় দোলা।
‘বৃষ্টির গান’ নামক ছড়ায় শিশুমানস কবি ফররুখ আহমদ বৃষ্টির দিনে গ্রামীণ চিত্র কেমন হয় তা এঁকেছেন। বকের দল বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে ঢুকে পড়েছে বাঁশবনে। মেঘের কড়কড় ডাক শুনে ভয়ে মাঝি নৌকো রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে ইত্যাদি তুলে এনেছেন ছড়াটির লাইনে লাইনে।
আমাদের বিশ্বকবি রবিঠাকুর তোমাদের জন্য বৃষ্টির দিনে বাইরে যাওয়া বারণ করে কবিতা লিখেছেন। কেননা চারদিক থৈথৈ জল। আকাশে বারংবার বিদ্যুৎ চমক। অনেক সময় কালো মেঘে ছেয়ে বিদঘুটে পরিবেশ তৈরি করে। যদি না জানো সাঁতার। আর যদিই বা বিদ্যুৎচমক তোমার ওপর পতিত হয় তবে তুমি কী বিপদের সম্মুখীন হতে পারো ভেবেছ কি একবার? কবি তাই বলতেছেন,
‘ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর
আউশের খেত জলে ভরভর
কালি-মাখা মেঘ ওপারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে।
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’
আমাদের বাবরি দুলানো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও বৃষ্টিকে তার কবিতায় স্থান দিয়েছিলেন। বিশেষ করে বৃষ্টিকালের ফুটে থাকা বাহারি ফুলেদের। বন্ধুরা মিষ্টি বৃষ্টির কাল বা বর্ষায় অনেক ফুল ফোটে। যেমন কদম, কেয়া, শাপলা, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা, হিজল, কলাবতী, চালতা, কলমিলতা, নীলকমল, এমনি নানান নামের ফুল ফুটে। সেরকম কয়েকটি ফুলের বর্ণনা দিয়ে দুখুমিয়া লিখেছেন,
‘রিমঝিম রিমঝিম ওই নামিল দেয়া
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া
ঝিলে শাপলা কমল
ওই মেলিল দল
মেঘ অন্ধ গগণ, বন্ধ খেয়া।’
শহুরে বর্ষা অনেকটা ঘরে বন্দি থাকা তাই তেমন আবেদন নেই ইট-পাথুরে মানুষদের কাছে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই পিচঢালা পথ হাঁটু থেকে কোমর জল হয়ে যায়। কর্মমুখী মানুষদের কী বিড়ম্বনা! রিকশা উলটে যাচ্ছে নোংরা পানিতে। রাস্তার মাঝখানে বিকল হয়ে পড়ে থাকে প্রাইভেটকার ইত্যাদি। কিন্তু পল্লীগ্রামে বাদলের ধারাপাত মানুষের মনকে উৎফুল্ল করে। জমিতে ধান বুনার পরিবেশ তৈরি করে। পাট জাগ দেয়ার অঢেল পানি হয়। সবমিলে যেন রূপকথার চিত্র আঁকে পল্লীকবি জসীমউদদীন। পল্লীগ্রামের সেই ঝরঝর বাদলের রূপকথা তিনি বুনেছেন এভাবে,
‘বাহিরে নাচিছে ঝরঝর জল
গুরুগুরু মেঘ ডাকে,
এসবের মাঝে রূপকথা যেন
আর রূপকথা আঁকে।’
বৃষ্টি যেমন থৈথৈ জলে চারদিক ভরিয়ে দিয়ে ভেলা বেয়ে চলার পরিবেশ করে তেমনি এঁটেল মাটি এলাকায় দলদলে পিচ্ছিল পরিবেশ তৈরি করে। পা পিছলে দলদলে কাদায় পোশাকাদি নষ্ট হয়। স্যাঁতসেতে পরিবেশ তৈরি হয়। লাগে ঘ্যানঘেনে। মুটে-মজুরদের হয় খুবই কষ্ট। তারা পারে না রোজগার করতে। তাই উপোষও করতে হয় তাদের। এমনই বরষার বর্ণনা দিয়েছেন বর্তমান সময়ের এক অসাধারণ ছড়াকার করিম সুমন। তার ‘শ্রাবণের প্লাবণে’ ছড়ার বর্ণনায় বরষার রূপ,
‘ঘ্যানঘেনে বিষ্টিতে
স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ,
অপরূপ বর্ষাটা
চেয়ে দেখা অনিমেষ।
ঘনদেয়া বরিষণে
পথঘাটে হাঁটুজল,
কষ্টের শেষ নেই
ছুটেচলা পায়ে দল।’
তোমাদের মতো এই বরষা বা শ্রাবণ দেখে আমাদেরও মনে পড়ে ছোট্টবেলার সেই দুরন্ত ঝরঝর ধারায় দু’হাত মেলে পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে হওয়ার। নদীতে গোসল করার। সাঁতরিয়ে প্রথম হওয়ার আনন্দের। কবিগুরুর ভাষায় তাই বলতে ইচ্ছে হয়,
‘বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান,
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এলো বান।’
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ৩১ জুলাই ২০১৯/ এমএম