Menu

১৪ জুন সত্তরে পা দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। জন্মদিন উপলক্ষে কয়েক দিন আগে নিজের সাম্প্রতিক কাজকর্ম ও লেখালেখি নিয়ে কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাফর আহমদ রাশেদ

জাফর আহমদ রাশেদ: এ মাসের ১৪ জুন ৭০-এ পা রাখছেন। অভিনন্দন। আমরা জানি, আপনি এখন একটা উপন্যাস লিখছেন ৭ মার্চের বিকেল নামে।এই উপন্যাস দিয়ে শুরু করি।
সেলিনা হোসেন: আমার মূল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ। এ উপন্যাসে আমি দেখাতে চাইছি, ৭ মার্চের বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে যারা উপস্থিত ছিল, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তারা কীভাবে শুনল, কীভাবে ওটাকে আত্মস্থ করল, কীভাবে মেসেজটা পেল। এ সবকিছু মিলিয়ে উপন্যাসটি হবে। তাতে ভাষণটির একটি বিবরণ থাকবে।
রাশেদ: উপন্যাসের পাত্রপাত্রী কারা?
সেলিনা: মূল নায়ক-নায়িকা দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আরও অনেক চরিত্র আসবে। এক ভিক্ষুক বুড়িমা, একজন বাদাম বিক্রেতা, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সমাজের আরও বিভিন্ন স্তরের মানুষ—যারা এই ভাষণটা সেদিন শুনবে।
রাশেদ: কতটা লিখেছেন?
সেলিনা: পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লিখেছি মাত্র।
রাশেদ: পুরোটাই কি সেদিনের বিকেলের বিবরণ?
সেলিনা: একাত্তরের ৭ মার্চ বিকেলটা থাকবে। সেখান থেকে শুরু। এক বছর পরে অর্থাৎ ১৯৭২-এর ৭ মার্চ মূল পাত্রপাত্রীকে আবার ওই মাঠে আনব।
রাশেদ: এক বছরের ব্যবধানে দুদিনের কাহিনি বর্ণনা করবেন?
সেলিনা: দুই দিনের না। মাঝখানে ওদের নিয়ে যাব ফ্ল্যাশব্যাকে। মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করল। যুদ্ধ করতে গিয়ে ছেলেটি তার একটা পা হারাল। একটা অপারেশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মেয়েটি। তাদের হাতে নির্যাতিত হয়। মেয়েটির সাহস, চিন্তা, স্বাধীনতার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা—এর জন্য সে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে। যুদ্ধের জন্য এটি তার অন্য রকম অবদান, আত্মত্যাগ। আমাদের স্বাধীনতার জন্য এ রকম আত্মত্যাগ কোনো ছেলেকে করতে হয়নি। তারা যুদ্ধ করেছে। শহীদ হয়েছে। হাত-পা হারিয়েছে। কিন্তু নারীদের বেলায় আমরা কেবলই বলি, তারা নির্যাতিত, বীরাঙ্গনা। কিন্তু তারাও তো যোদ্ধা। তাদের আত্মদানটাই বেশি।
রাশেদ: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনি আরও উপন্যাস লিখেছেন। সেগুলোর সঙ্গে এ উপন্যাসে বিশেষ কোনো পার্থক্য ঘটছে বলে আপনার মনে হয়?
সেলিনা: পার্থক্য এই অর্থে যে আমি ওই বিকেলটিকে, ৭ মার্চের ভাষণটিকে বেশি করে তুলে ধরব। যেমন, বাদাম বিক্রেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেটি জিজ্ঞেস করছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আপনার কোন লাইনটি বেশি ভালো লেগেছে? কেউ তো আর মুখস্থ করেনি, শুনেছে মাত্র। বাদাম বিক্রেতা বলল, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ একজন বলল, আমার ভালো লেগেছে ‘ভাতে মারব, পানিতে মারব’। কারণ ওরা তো দেখতে পাচ্ছে, পাকিস্তানি সেনারা মাঠটি চারদিক ঘেরাও করে রেখেছে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ছে হেলিকপ্টার। তাই ‘ভাতে মারব, পানিতে মারব’ শুনতেই অনেকের ভালো লেগেছে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু একবারও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ উচ্চারণ করেননি। সব সময় বলেছেন ‘পূর্ব বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’। ‘বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, অধিকার চায়’—এভাবেই বলেছেন। এক ভিক্ষুক বৃদ্ধা, বাংলা একাডেমির সামনে রেসকোর্সের কাঁটাতারের বেড়া ধরে বসে আছে, ভেতরে ঢুকতে পারেনি, ভাষণটা শুনে বলছে, ‘ব্যাটা একখান’। এর বেশি তার অভিব্যক্তি নেই। একজন বলছে, এটা মঞ্চ, স্বাধীনতার মঞ্চ। চলো, আমরা ছুঁয়ে আসি।
রাশেদ: সেদিন, অর্থাৎ একাত্তারের ৭ মার্চ আপনি কোথায় ছিলেন?
সেলিনা: ছিলাম ওখানেই, রেসকোর্সে।
রাশেদ: আপনার উপন্যাসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী চরিত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, এই উপন্যাসের মধ্যেও কি নারী চরিত্রগুলো বিশেষভাবে তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে?
সেলিনা: ছেলেটি ও মেয়েটি প্রেমিক-প্রেমিকা। দুজনেই যুদ্ধ করেছে। কিন্তু মেয়েটির আত্মদানটা বেশি। কিন্তু এ দেশে তার মূল্যায়ন হয়নি। এই অর্থে মেয়েটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।
রাশেদ: এটা কি কোনো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, যে কারণে মেয়েই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে?
সেলিনা: ওইভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে দেখাব না। কেননা, দুজনেই সমানভাবে যুদ্ধ করেছে।
রাশেদ: উপন্যাসটি শেষ হতে কত সময় লাগবে?
সেলিনা: এ বছরই শেষ করব। আশা করছি বইমেলায় বেরোবে। দেখি পারি কি না। হাতে এখন বেশ কাজ আছে।
রাশেদ: আপনি তো ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘টেগোর ফেলোশিপ’ পেয়েছেন। কারা দিয়েছে এটি?
সেলিনা: দিয়েছে টেগোর সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব কালচার অ্যান্ড সিভিলাইজেশন অ্যাট দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডি, সিমলা। এটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বড় প্রতিষ্ঠান।
রাশেদ: ওখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কী কাজ করতে হবে আপনার?
সেলিনা: ওরা কিছু নির্ধারণ করে দেয়নি, বলেছে, প্রতিষ্ঠানটি সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়ে কাজ করে। আমি চিন্তা করেছি এই ফেলোশিপের আওতায় আমি ‘রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ’—এ রকম একটি বিষয়ে কাজ করব।
রাশেদ: পূর্ববাংলায় রবীন্দ্রনাথের যেসব অঞ্চলে যাতায়াত ছিল, শিলাইদহ, শাহজাদপুর—ওই অঞ্চল নিয়ে আপনি আগেই একটা উপন্যাস লিখেছেন,পূর্ণ ছবির মগ্নতা। সেদিক থেকে এই অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের কাজকর্ম নিয়ে আপনার পড়াশোনা আছে। সেগুলো কি এ গবেষণায় কাজে দেবে?
সেলিনা: কিছু সাহায্য করবে। বইগুলো আমার সংগ্রহে আছে, অনেক উপাত্ত আছে সংগ্রহে। সেগুলো তো কাজে দেবেই। আইডিয়ার দিক দিয়ে এ গবেষণায় ছিন্নপত্র-এর অনেক কিছু আমি ব্যাখ্যা করতে পারব। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যাত্রাপথে বাংলাদেশকে কীভাবে দেখেছেন? পতিসর থেকে যখন নৌকায় করে যাচ্ছেন, প্রবল বন্যার বর্ণনা দিচ্ছেন, বলছেন নারীরা কীভাবে স্নান করছে, হাঁড়িকুড়ি ধুচ্ছে, বাচ্চারা স্নান করছে। একটা বড় গাছ, মাথার ওপর ঝুলে আছে সাপ। ছিন্নপত্রতে এসবের বর্ণনা আছে। সেখানে তিনি বলছেন, মানুষের জীবনে দুর্যোগ তিন রকম। একটা হলো প্রাকৃতিক। দ্বিতীয় রাজা, মানে শাসনব্যবস্থা যারা পরিচালনা করে, তৃতীয়টি শাস্ত্র অর্থাৎ ধর্ম।
রাশেদ: এই তিনটি প্রসঙ্গ কেন আসছে?
সেলিনা: আমি দেখাব, এত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যা বলে গেছেন, এখন তা বাংলাদেশে ঘটছে।
রাশেদ: বইটি বাংলায় লিখবেন?
সেলিনা: আমি বাংলাতেই লিখব। ওরা ছাপবে ইংরেজিতে।
রাশেদ: বাংলাদেশের একদম সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত আসবেন?
সেলিনা: সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত তো ওইভাবে আসতে পারব না। তিন দুর্যোগের কথা যদি বলি, আমরা এখন যে গুড গভর্নেন্স বা সুশাসনের কথা বলছি, তা যে হচ্ছে না, সেটি এ দুর্যোগের কারণে।
শাসক আর শাস্ত্রই তো সুশাসনের প্রধান অন্তরায়। রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃতিটা দিয়ে আমি বলব যে এখনকার বাংলাদেশে গুড গভর্নেন্স কীভাবে চলছে?
রাশেদ: এর মধ্যে কি মুক্তিযুদ্ধ আসবে?
সেলিনা: মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে আসবে, আমি জানি না। দেখি, ঘাঁটাঘাঁটি করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ওভাবে কোনো সূত্র পাই কি না?
রাশেদ: আপনি একদিন বলেছিলেন, এ গবেষণায় বঙ্গবন্ধুও আসবেন।
সেলিনা: আমার শুরুর অধ্যায়ই ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শেখ মুজিবুর রহমান।’
রাশেদ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এই যোগাযোগটা কীভাবে দেখাবেন?
সেলিনা: রবীন্দ্রনাথের ভাবনাগুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কতটা যুক্ত ছিলেন? যেমন, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা। তারপর পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করল বেতার-টেলিভিশনে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হয়ে আসার পর রেসকোর্স ময়দানে যখন বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো, তিনি বললেন, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইব। আমাদের সংস্কৃতি এবং চেতনার বাইরেও একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আমাদের রাজনীতির সঙ্গে তিনি কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করলেন, যুক্ত করলেন—সেটা আমি দেখাব। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাকে প্রভাবিত করেছেন।
রাশেদ: কীভাবে পূর্ব বাংলা বাংলাদেশ হয়ে উঠল—এটিই কি বোঝাতে চাচ্ছেন আপনি?
সেলিনা: হ্যাঁ।
রাশেদ: এখন তো আপনার গল্প লেখা কমে গেছে। সম্প্রতি গল্প লিখেছেন?
সেলিনা: তিনটি গল্প লিখেছি। প্রথম আলোয় একটা দিয়েছি।
রাশেদ: সম্পাদক বা সাহিত্য সম্পাদকদের অনুরোধ না থাকলে মনে হয় এখন গল্প খুব একটা লেখা হয় না।
সেলিনা: না, এমন নয়। কী গল্প লিখব, আগে থেকে মাথায় থিম তৈরি থাকে। কেউ চাইলে লিখে দিই। যেহেতু অন্য কাজ থাকে, তাই অনুরোধেই আসলে বেশি হয়, তখন একটা তাগাদা বোধ করি গল্পটি শেষ করার।
রাশেদ: আমাদের দেশে এখন যে কিছু কিছু গল্পে ঠিক গল্প থাকে না, এ ধরনের গল্প সম্পর্কে বলুন।
সেলিনা: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক বাংলাদেশের একজন কথাশিল্পীর নাম উল্লেখ করে আমাকে বলেছেন, তাঁর গল্পে কোনো কাহিনি নেই, গল্প নেই। আমি বলেছি, গল্পকার হিসেবে আমি যদি মনে করি, এখানে গল্প আছে, যদি মনে হয়, আমি এটুকুই চাই গল্পের কাছ থেকে, তাহলেই এিট গল্প। বিষয়টি এখন পাঠকের ওপর নির্ভর করছে, পাঠক একটি কাহিনিসর্বস্ব নিটোল গল্প চাচ্ছে, নাকি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ চাচ্ছে কিংবা কোনো ঘটনার বিবরণ চাচ্ছে, যা দিয়ে মানুষের একটি জায়গা, তার জীবনযাপনের একটি জায়গাকে ধরা যায়।
রাশেদ: কেউ যদি একটা নিটোল গল্প লেখেন, তার মধ্যে কি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থাকতে পারে না?
সেলিনা: সেটি তো থাকবেই।
রাশেদ: অনেক ধরনের লেখক থাকবেন। কেউ নিটোল গল্প বলবেন, কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন। কিন্তু পাঠকের অভিযোগ, আমাদের দেশের উপন্যাসে মোটের ওপরে আমরা বড় আয়তনের গল্প বলতে পারি না। আমাদের ঔপন্যাসিকেরা হয় বড় আয়তনের গল্প বলতে চান না, বা বলতে পারেন না; নিটোল গল্পও বলতে পারেন না।
সেলিনা: আমার সেটি মনে হয় না।
রাশেদ: তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের মতো লেখককে বাদই দিন, এর বাইরে মনোজ বসু, নিমাই ভট্টাচার্য, বিমল মিত্র, গজেন্দ্রকুমার মিত্র; তাঁরা যে বিরাট ক্যানভাসে একটি নিটোল গল্প বলতেন, সেটি আমাদের লেখকদের মধ্যে একটু কম নয় কি?
সেলিনা: হ্যাঁ, একটু কম।
রাশেদ: উপন্যাসের বিক্রি এখন কমেছে। ইতিহাস ও রাজনীতির বই বেশি বিক্রি হয়। এই যে উপন্যাস-ছোটগল্পের বইয়ের বিক্রি খুবই কমে গেল, এটা কি হতে পারে যে এগুলোর মধ্যে পড়ার মতো গল্প পাঠক পাচ্ছে না?
সেলিনা: অথবা পাঠকের মনোযোগ অন্য দিকে যাচ্ছে। যেমন—ইতিহাস বা রাজনীতির বইয়ের কথা যে বললে। আমার মনে হয়, সাময়িকভাবে উপন্যাসের স্রোতটা তো ভিন্ন হতেই পারে। পড়ার মতো গল্প পাঠক পাচ্ছে না, আমি তা বলব না। কেননা, এই সময়ের গল্পও তো লেখা হচ্ছে। সমসাময়িক বাস্তবতার গল্প কি লেখা হচ্ছে না?
রাশেদ: কথাসাহিত্যে নিটোল গল্প বলার ঐতিহ্য ছিল আমাদের। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, আরও পরে নজিবর রহমানের আনোয়ারা, কোরবান আলীর মনোয়ারা–এর মধ্যে কিন্তু নিটোল গল্প বলার প্রবণতা আছে। এরপর আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা, হয়তো নাগরিক হয়ে একটা জটিল জগৎ গড়ে তুললেন।
সেলিনা: তুমি বলো, চাঁদের অমাবস্যা কি একটা নিটোল গল্প? এটি ছাপা হয়েছে ১৯৬৪ সালে।
রাশেদ: একদল লেখক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। চাঁদের অমাবস্যার মতো উপন্যাসও লেখা হবে। তবে নিটোল গল্প বলিয়ে—মনোজ বসু, বিমল মিত্র, নিমাই ভট্টাচার্যের মতো লেখকও তো থাকবেন। তাঁরা কই? আমরা কি সেই ধারাটিকে একেবারে বাদই দিয়ে দিলাম?
সেলিনা: আমাদের দেশে সেটি নেই। আমরা সেটিকে বাদ দিইনি, তবে অন্য ফর্ম তৈরি করছি। গল্প বলার ভিন্ন ফর্ম তৈরি করেছি আমরা।
রাশেদ: ভিন্ন ফর্ম মানে উপন্যাসে নিটোল গল্পের ধারায় না গিয়ে আমরা কি একটা অন্য আঙ্গিক খুঁজছি?
সেলিনা: আমি এমনটিই মনে করি। ধরো, লালসালু যে বের হলো, ওটা কিন্তু সেই অর্থে নিটোল গল্প না।
রাশেদ: তারপরেওলালসালুতে একটি গল্প আছে। চাঁদের অমাবস্যার ক্ষেত্রে আমি আপনার সঙ্গে একমত, নিটোল গল্প নেই।
সেলিনা: না না। লালসালুতে একদম নিটোল গল্প সেই অর্থে নেই। ভণ্ড পীর মজিদ একটি মাজার তৈরি করেছে। সে বিয়ে করেছে জমিলাকে। তাকে নিয়ে মজিদ মাজারে ঢুকছে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। ওদিকে জমিলা তার হাসব্যান্ডকে অস্বীকার করছে। এর আগে মজিদ যখন ওকে দেখতে গিয়েছে, জমিলা তাকে দেখে বলছে, আল্লাহ, এ তো দেখতে আমার বাবার মতো। জমিলা যখন মজিদের বাড়িতে এসেছে তখন সে মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমার সঙ্গে ঘুমাচ্ছে, রহিমাই তাকে বুকে আগলে রাখছে। জমিলা তার স্বামীর শয্যায় যায়ই না। এই যে যায় না, এর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটি যত বেশি, একটি নিটোল গল্পের মধ্যে তা থাকে না।
রাশেদ: আপনাদের সমসাময়িক একজন লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদ, তিনি স্টোরি বলতে পারতেন।
সেলিনা: হ‌ুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল এটা পারেন। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ক্ষেত্রে যেটা বলছি, ওই অর্থে ওয়ালীউল্লাহ কিন্তু নিটোল গল্প বলেননি।
রাশেদ: তরুণদের লেখালেখির খোঁজখবর রাখেন আপনি। কেমন মনে হচ্ছে এখনকার ছোটগল্প বা উপন্যাস?
সেলিনা: গল্প-উপন্যাস নিয়ে আমি খুব নিরাশ নই। পাটশ্রমিকদের পটভূমিকায় কালচক্রনামে একটা উপন্যাস লিখেছে আবদুল্লাহ ইমরান নামে এক তরুণ। আমার খুবই ভালো লেগেছে। ওর কিছু ট্রিটমেন্ট আছে। ওই ট্রিটমেন্টের জন্য উপন্যাসটিকে আমার অন্য রকম মনে হয়েছে। ধাতবসময় নামে ইমরান খানের একটা উপন্যাস পড়েছি, একটু ভিন্ন ধরনের। স্বকৃত নোমানের মধ্যেও একটা সম্ভাবনা আছে। ও ডিটেইলসে গিয়ে গল্প বলে। এ ছাড়া পিয়াস মজিদ, সুমী সিকান্দারের কবিতাও ভালো লাগে। বয়সেরও তো একটা ব্যাপার আছে। তাই কবিতা, প্রবন্ধ এবং গল্প—সামগ্রিক অর্থে আমি মোটেই হতাশ নই। (প্রথম আলোর সৌজন্যে)