Menu

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই বাংলাদেশের নাম যুক্ত করে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। বোস্টনপ্রবাসী বেশ কয়েকজন দেশপ্রেমীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড’ (বেইন)। তাঁদের অন্যতম একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. বিনয় ভূষণ পাল। প্রায় ৫৩ ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন তিনি। ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের মেডফোর্ড শহরের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে অবসর যাপন করছেন। বোস্টনের পার্শ্ববর্তী কুইন্সি শহরের নিজ বাড়িতে একাকী জীবন কাটছে তাঁর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসে বাংলাদেশিদের ভূমিকা এবং দেশ ও প্রবাসের নানা বিষয় নিয়ে ড. বিনয় ভুষন পাল কথা বলেন বাংলা প্রেস’র সঙ্গে । সাক্ষাত্কার নিয়েছেন বাংলা প্রেস ডটকম সম্পাদক সাবেদ সাথী

বাংলা প্রেস: কেমন কাটছে আপনার দিনকাল?

ড. বিনয় পাল : এখন অনেক বয়স হয়েছে, তাই আজ ভালো তো, কাল খারাপ। সব মিলিয়ে ভালই কাটছে দিনকাল।

বাংলা প্রেস: যুক্তরাষ্ট্রে আসার পূর্বে আপনি দেশে কি করতেন?

ড. বিনয় পাল : আমি ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাশ করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিষ্ট্রি বিভাগে ৩ বছর শিক্ষকতা করেছি। এরপর স্কলারশীপ নিয়ে পিএইচডি করতে ১৯৬০ সালে প্রথমে কানাডার মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেখানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি।

বাংলা প্রেস: স্বাধীনতালাভের আগেই ‘বাংলাদেশ’ নাম যুক্ত করে সুদূর প্রবাসে বসে এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলার নেপথ্যে অনুপ্রেরণাটা কোথায় পেলেন?

ড. বিনয় পাল : তখন বাংলাদেশ নামে কোন কিছুই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান নামেই আমেরিকার মানুষ চিনত আমাদের দেশকে। কেউ পড়াশোনা, কেউবা শিক্ষকতার চাকুরি নিয়ে আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে তখন বোস্টনে থাকতাম। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের খবর জানতে পেরে আমরা নিজেদের ফ্যামিলি নিয়ে ভীষন টেনশনে ছিলাম। সত্তরের নভেম্বরে আমার স্ত্রী দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের পর তার আর কোন খোঁজ পাচ্ছিলাম না। সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে কোন খবরই কেউ দিতে পারেনি। তখন সার্বক্ষনিক টেলিফোন করার মত ব্যবস্থাও ছিল না। ইন্টারনেট ব্যবস্থা একেবারেই নেই বললেই চলে। ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষেরা কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর আগেই ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার শুরু হয়েছিল। তখনও আমার স্ত্রীর খোঁজ মেলেনি। খুব উদগ্রিব হয়েছিলাম। এরই মধ্যে ৭ মার্চ ড. মাহবুবুল আলম, তায়েব উদ্দিন মাহতাব ও সোহরাব হোসেন আমরা ক’জন বন্ধু মিলে হার্ভার্ড স্কোয়ারে আড্ডা দিতে বসেছিলাম। কথা হচ্ছিলো ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত এলাকার মানুষের জন্য আমরা কিছু অর্থ সংগ্রহ করে দেশে পাঠাবো। কিন্তু তখনও আমরা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষন শুনতে পাইনি। বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তানি সেনারা অত্যাচার শুরু করেছে শুধু এই স্পর্শকাতর বিষয়টি থেকেই ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন’ নামকরনে একটি সংগঠন করার চিন্তা করি। একদিন না পেরুতেই এরই মধ্যে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুরের সেই ঐহিহাসিক ভাষনটি কোন একটি রেডিওতে শুনতে পাই। দেশের খবরা-খবর নেওয়ার জন্য তখন আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল রেডিওর খবর। বিবিসি বা অন্য কোন রেডিও। বঙ্গবন্ধুর ভাষন শোনার পর আমরা চূড়ান্তভাবেই সিদ্ধান্ত নেই সংঠনের নামে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি সংযুক্ত করার। বোস্টনে বসবাসরত বাঙালিদের জন্য এ সংগঠনটির নামকরন করা হয় ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড’ (BANE-বেইন)। এখানে উল্লেখ্য যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি অঙ্গরাজ্য ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, ভারমন্ট, নিউ হ্যাম্পশয়ার, মেইন ও রোড আইল্যান্ডকে নিউ ইংল্যান্ড বলা হয়ে থাকে।

বাংলা প্রেস: সংগঠনের নামে ‘বাংলাদেশ’ যুক্ত করার পেছনে কী যুক্তি ছিল?

ড. বিনয় পাল : তেমন কোনই যুক্তি ছিল না। শুধুমাত্র আমাদের মাঝে একটি আবেগ কাজ করেছে মাত্র। সেটি হল বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে তার উপর পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ। স্পর্শকাতর এ বিষয়টি আমাদেরকে ভীষনভাবে নাড়া দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করে দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’ সেই চিন্তাও তখন আমাদের মাথায় ছিল না। আবেগ থেকেই ‘বাংলাদেশ’ নামকরন করা হয়। তবে দেশ স্বাধীনের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে সংগঠন করতে পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করি।

বাংলা প্রেস: আপনাদের হাতেগড়া ‘বেইন’ এখন নিউ ইংল্যান্ড তথা বোস্টনে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রত্যয়ে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও চলাচ্ছেন। আপনি কি মনে করেন বেইন সেই ধারাবাহিকতা বা দেশের ঐতিহ্য বহন করছে?

ড. বিনয় পাল : বেইনে এখন আর সেই ঐতিহ্য বা ধারাবাহিকতা নেই। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মানসিকতারও একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে এই সংগঠনটিকে নিয়ে নানা রকম রাজনীতি হচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি বেইনকে তাদের প্লাটফরম হিসেবে ব্যবহার করছেন। শুধু তাই নয় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির লোকেরাও হাল ধরেছেন এ সংগঠনটির । কখনো নির্বচিত হয়ে,আবার কখনো বা মনোনীত হয়ে। স্বাধীনতা বিরোধীদের যখন এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে মতব্বরি করতে দেখি তখন আর তাদের কোন অনুষ্ঠানে যেতে ইচ্ছেও করে না। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। তখন ভাবি এই বুঝি গেল।

বাংলা প্রেস: অন্য কোনো সংগঠন কিংবা মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা আছে কি?

ড. বিনয় পাল : বেইন গঠনের আগে ১৯৬৯ সালের দিকে আমরা দুই বাংলার বাঙালিদের সমন্বয়ে ‘ট্যাগর সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন করেছিলাম। এ সংগঠনটি মূলত করা হয়েছিল বাঙালিদের ঐতিহ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্য। কিন্তু এটা বেশিদিন চালাতে পারিনি। এরমধ্যেই বেইন গঠন করার চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। মূলধারার রাজনীতি বলতে আমি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রাট দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছি। এ দলের বিভিন্ন কর্মকান্ডেও অংশ গ্রহন করে থাকি।

বাংলা প্রেস: ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু বলুন।

ড. বিনয় পাল : আমার শৈশব কেটেছে নোয়াখালীর গোপিনাথপুরে মামার বাড়িতে। আমার নানা শশী গোপাল পাল ছিলেন ওই এলাকার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। তাঁকে এক নামেই চিনত সবাই। সেখানে হাইস্কুল পর্যন্ত লেখাপড়া করি এরপর ভর্তি হই কুমিল্লা কলেজে। সেখানে কলেজ গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ১৯৫৭ মাস্টার্স অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করি। একই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ পাই। সেখানে প্রায় ৩ বছর বায়োকেমিষ্ট্রি বিভাগে শিক্ষকতা করি।

বাংলা প্রেস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কর্মজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন?

ড. বিনয় পাল : স্কলারশীপ নিয়ে পিএইচডি করতে ১৯৬০ সালে কানাডার মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেখান থেকে ১৯৬৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোষ্ট ডক্ট্ররাল সম্পন্ন করি। ওই সময় নিউ ইয়র্কের ডাউন ষ্ট্রিটের একটি মেডিক্যাল সেন্টারে হিসেবে চাকুরি শুরু করি। ১৯৬৬ সালে বোস্টনে আসার পর টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেই।

বাংলা প্রেস: দেশের অবস্থা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

ড. বিনয় পাল : বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ভালোই বলা যায়। সব কিছুই ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎ কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকায় দেখি শুধু হত্যা আর খুনের খবর। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের নানা ধরনের নির্যাতন চলছে কিন্তু কোন ঘটনার তেমন বিচার হচ্ছে না। ফলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠিরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। হিন্দু বৌদ্ধ আর খ্রিষ্টানদের উপর এখন নির্যাতনের সাথে খুন করা হচ্ছে অহরহ। সরকার যদি এসব হত্যাকান্ড অচিরেই বন্ধ না করে তাহলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বসবাস কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থকে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার আবেদন যথা শিগগির সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ করে প্রবাসী হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের চিন্তামুক্ত রাখুন।

বাংলা প্রেস: ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।

ড. বিনয় পাল : আমি ১৯৬৭ সালে বিবাহ বন্ধলে আবদ্ধ হই। স্ত্রীর নাম শ্যামলী পাল। বরিশালের তৎকালীন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ প্রাণকুমার সেনের মেয়ে। আর আমার দেশের বাড়ি নোয়াখালীতে, বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার বিজয়নগরে। বৈবাহিক জীবনে আমাদের একটি মাত্র মেয়ে রয়েছে। তার নাম ড. দেবিতা পাল। সে পিএইচডি সম্পন্ন করার পর ম্যাসাচুসেটেসের ওরচেস্টারে একটি কোম্পানি চাকুরি করছে।

বাংলা প্রেস: একজন প্রবীণ প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে প্রবাসীদের জন্য আপনার বার্তা কি?

ড. বিনয় পাল : যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আমার বার্তা হল, প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। মতপ্রকাশের জন্য এদেশের স্বাধীনতা আরও একটু বেশি। রাজনীতি বা সামাজিক সংগঠন যাই করি না কেন দেশের সুনাম কোন ভাবেই যেন ক্ষুন্ন না হয়। সেদিকে সকলকেই খেয়াল রাখতে হবে। প্রবাসে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের কাছে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। ইতিহাস বিকৃত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভ্রাতৃত্ব বজায় রেখে সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কাজ করলেই সার্থক হবে আমাদের প্রবাস জীবন।

বাংলা প্রেস: বাংলা প্রেসকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ