Menu

আধুনিক বিপণন ব্যবস্থায় পিআর অ্যান্ড মিডিয়ার গুরুত্ব অনেক : মুহাম্মদ ফিরোজ আলম

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে প্রতিষ্ঠান এবং পণ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পিআর, মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং ব্র্যান্ডিং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই দ্রুত সময়ে জনপ্রিয় পেয়েছে পিআর ও মিডিয়া বিভাগ। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ গুরুত্বের চোখে দেখছেন এ বিভাগকে। পিআর, মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং ব্র্যান্ডিং নিয়ে কথা বলেন ওয়ালটন গ্রুপের সিনিয়র ফাস্ট এডিশনাল ডিরেক্টর (পিআর অ্যান্ড মিডিয়া) মুহাম্মদ ফিরোজ আলম। তিনি জানান এই পেশায় যারা নতুন তাদের ক্যারিয়ার, এগিয়ে চলার কথা। পরামর্শ, টিপস আর গাইডলাইনও দিয়েছেন যারা জড়িত হতে চান এই পেশায়। মুহাম্মদ ফিরোজ আলমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাজমুল হক ইমন

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: প্রতিষ্ঠান এবং পণ্য ব্র্যান্ডিংয়ে পিআর অ্যান্ড মিডিয়া ম্যানেজারের কাজ?

মুহাম্মদ ফিরোজ আলম : এক সময় তেমন গুরুত্ব না থাকলেও আধুনিক বিপণন ব্যবস্থায় পিআর অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি দেশের মানুষের কাছে ভালো হবে না কি মন্দ হবে সেটার অনেকটা নির্ভর করে এই বিভাগের দক্ষতার ওপর। একজন পিআর ম্যানেজারকে অবশ্যই প্রেজেন্টেবল ও বিনয়ী হতে হবে। প্রচণ্ড চাপেও হাসিমুখে কথা বলায় অভ্যস্ত হতে হবে। আর মিডিয়া ম্যানেজারকে দেশের সকল মিডিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে। ধারণা রাখতে হবে কোন মিডিয়া জনগণের ওপর কতটা প্রভাব রাখে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে মিডিয়া বিভাগ বিজ্ঞাপন তৈরির কাজটি তদারকি করে। তাই মিডিয়া ম্যানেজারদের কিছুটা সৃজনশীল হওয়ারও প্রয়োজন আছে বৈকি। এ ছাড়াও মিডিয়া ম্যানেজমেন্টর মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশের যে কোনো স্থানে করার মানসিকতা থাকতে হবে। কোনো পণ্যের ব্র্যান্ডিংটা যেহেতু অনেক বিভাগের সমন্বিত কাজ, সেহেতু মিডিয়া ম্যানেজারকে নেতৃত্বদানে দক্ষ হতে হবে। একজন পিআর ও মিডিয়া ম্যানেজারকে ইংরেজি ভাষা ও আইটিতে দক্ষ হতে হবে। পুঁথিগত পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি ভোক্তার আচরণ পরিবর্তনের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নিজেকে বিক্রেতার জায়গা থেকে সরিয়ে ক্রেতার আসনে বসাতে হবে। আমরা যে পেশায় থাকি না কেন এক জায়গায় আমরা সবাই এক। সেটা হলো আমরা সবাই ক্রেতা। একজন ক্রেতা হিসেবে আপনি অন্য ব্র্যান্ডের যে বিষয়গুলো পছন্দ করছেন না সে ভুলগুলো আপনার ব্র্যান্ড প্ল্যান থেকে বাদ দিন।

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বর্তমানে দেশের বাজারে ব্র্যান্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা?

মুহাম্মদ ফিরোজ আলম : দেশের বাজারে পণ্য ব্র্যান্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ভোক্তাদের সচেতনতার অভাব। একটি পণ্যকে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাতে অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। এর সবকিছু করা হয় ভোক্তার মন জয় করতে। অনেক কষ্টে ভালো একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করলেন আপনি। এখন অন্য কোনো কোম্পানি বাজারে এসে আপনার নাম ও মোড়কের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি সমজাতীয় পণ্য বাজারজাত করল। ভোক্তারা তখন আপনার ব্র্যান্ডিংয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই ননব্র্যান্ড পণ্যটি কিনে নিয়ে যায়। এতে করে ভোক্তা ঠকছেই সেই সাথে আপনিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অথচ ভোক্তারা একটু সচেতন হয়ে পণ্য কিনলেই কিন্তু নিজেরাও যেমন ভালো পণ্যটি বেছে নিতে পারেন আবার মানসম্পন্ন পণ্যের উৎপাদকরাও লাভবান হতো। এরপর ধরুন পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বিজ্ঞাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কিন্তু আমাদের দেশে ইলেক্ট্রনিক্স কিংবা প্রিন্ট এই দুই ধারারই কোনো গণমাধ্যমটি বেশি জনপ্রিয় তার কোনো উন্নত মাপকাঠি নেই। তাই পণ্যের প্রচারের জন্য ব্র্যান্ড ম্যানেজারদের হিমশিম খেতে হয়। অনেক সময় নিজেদের বিবেচনা আর কিছু কিছু রিপোর্ট ফলো করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এতে করে সময় এবং অর্থ দুটোরই অপচয় হয়। এমন আরো অনেক অনেক প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে এদেশে একটি ব্র্যান্ড দাঁড়ায়।

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ব্র্যান্ডিংয়ের প্রতিবন্ধকতা?

মুহাম্মদ ফিরোজ আলম : দেশের বাইরে একটি পণ্যকে পরিচিত করাই কষ্টের। আর ব্র্যান্ড মানেই যেহেতু আস্থা সেহেতু পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের আস্থাশীল করাটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। একটি নতুন বাজারে প্রবেশ করেই আপনি পণ্য বিক্রি করেতে পারবেন না। প্রথমে আপনাকে ভোক্তাদের জানাতে হবে যে অমুক দেশে থেকে একটি ভালো পণ্য এসেছে আপনি সেটা ট্রাই করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পণ্যটির ব্যাপক প্রচার করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আপনি চাইলেই ইচ্ছেমত বিদেশে টাকা নিয়ে যেতে পারবেন না। যদিও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সময়টা চলে যায় অনেক। এরপর ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির সমস্যা তো আছেই। বিভিন্ন দেশ তাদের স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে কিছু শুল্ক ও অশুল্ক বাধা সৃষ্টি করে রাখে। তখন সেখানে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হয় আমাদের। এরপরও ওয়ালটন ছাড়াও আরো কিছু বাংলাদেশি ব্র্যান্ড আন্তর্জাতিক বাজারে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে।

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: বিজ্ঞাপন প্রচারে পরিকল্পনা?

মুহাম্মদ ফিরোজ আলম : ওয়ালটন বাংলাদেশের মিডিয়ায় অন্যতম বড় বিজ্ঞাপনদাতা। এক্ষেত্রে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করি। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাও থাকে আমাদের। আসলে আপনি যে পরিকল্পনাই করুন না কেন সেটাকে চলমান রাখতে হবে। কেউ কেউ হঠাৎ অনেক বড় অংকের বিজ্ঞাপন বাজেট ব্যয় করেন। এরপর আর তাদের মিডিয়ায় উপস্থিতি দেখা যায় না। এতে গ্রাহকের সাময়িক আগ্রহ সৃষ্টি হলেও আস্থার ঘাটতি দেখা দেয়। বিজ্ঞাপন খাতে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করলেই কিন্তু ক্রেতাদের আস্থা বাড়ে না। মূল বিষয় হলো বিজ্ঞাপন প্রচারের ধারাবাহিতা বজায় রাখা। ধারাবাহিকভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার করলে দীর্ঘমেয়াদিভাবে ক্রেতাদের মনে প্রভাব বিস্তার করা যায়। ধরুন আপনার এলাকায় বিকট কোনো শব্দ হলো। আপনি চমকে উঠলেন। কান পেতে রইলেন কি হলো বোঝার জন্য কিন্তু আর কোনো শব্দ হলো না। আপনি আবার হয়তো কাজে মনোযোগী হয়ে যাবেন। অথচ পানির ফোঁটা পড়ার শব্দও একনাগাড়ে হতে থাকে তখন কিন্তু সচকিত হয়ে সেটার উৎস খুঁজবেন। বিজ্ঞাপনের বিষয়টাও তেমন। আরেকটি বিষয় হলো টার্গেট গ্রুপ অনুসারে বিজ্ঞাপনের মাধ্যম ও ধরন নির্ধারণ করা। ধরুন কেউ মোহাম্মদপুরে একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছেন। সেটির জন্য জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিলেন। এতে উনার অনেক টাকা ব্যয় হয়ে যাবে। অথচ সারাদেশ থেকে কিন্তু এই রেস্টুরেন্টে সবাই খেতে আসবে না। এর চেয়ে যদি স্থানীয় নিউজ পেপার এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে লিফলেট বিলি করতেন তবে তিনি অনেক অল্প খরচে অনেক সুন্দর কাগজে মোহাম্মদপুরবাসীকে উনার রেস্টুরেন্টের খবর পৌঁছে দিতে পারতেন। আবার ধরুন এমন কোনো কোম্পানি যাদের দেশব্যাপী শো-রুম আছে তাদের এই পদ্ধতি লাভজনক হবে না। কারণ একটি লিফলেট ছাপানো ও বিতরণ বাবদ প্রায় ৩ টাকা খরচ পড়ে। অথচ জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে পার পার্সন রিচের জন্য ৫০ পয়সাই যথেষ্ট। এখানে দেখা যাচ্ছে এক পণ্যের জন্য যে পদ্ধতি ভুল আরেক পণ্যের জন্য সেটাই লাভজনক।

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: এই পেশার বর্তমান বাজার?

মুহাম্মদ ফিরোজ আলম : আজকাল প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পিআর, মিডিয়া এবং ব্র্যান্ডিং ডিপার্টমেন্টকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই এই পেশাগুলোর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এসব পেশায় সাধারণত শুরুর পদ হয় জুনিয়র এক্সিকিউটিভ অথবা জুনিয়র অফিসার। অবশ্য প্রতিষ্ঠান ভেদে ভিন্নও হতে পারে। প্রাথমিকভাবে প্রার্থীর একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখা হয়। পিআর বিভাগের ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে আসা ছেলেমেয়েদের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। মিডিয়া এবং ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে বিজনেস ফ্যাকাল্টির ছেলেমেয়েরা নিশ্চিতভাবে অগ্রাধিকার পাবে। অন্য অনুষদের যারা আছে তাদের জন্যও সুযোগ আছে। আসলে এসব পদের ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানকে বেশি মূল্যায়ন করা হয়। চাকরির সাক্ষাতকারের সময় প্রার্থীর সপ্রতিভতা, বাচনভঙ্গি, বিনয় ইত্যাদি খেয়াল করা হয়। কাজকর্মে চটপটে আর হাসিমুখে সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। যারা এসব পেশায় আসতে চায় তাদের স্থানীয় বাজারের পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের সর্বশেষ অবস্থার ধারণা রাখতে হবে। বিশেষ করে যে ব্র্যান্ডে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন এবং তার প্রতিযোগী ব্র্যান্ডগুলোর খুঁটিনাটি জানা থাকতে হবে। মৌখিক পরীক্ষায় নিয়োগকর্তা নিজের ব্র্যান্ডের শক্তি ও দুর্বলতা জানতে চাইতে পারেন। সেক্ষেত্রে আন্দাজে কিছু না বলে নিজের সপ্রতিভতা দিয়ে নিয়োগকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। যাদের লেখালেখির অভ্যাস আছে, ফটোগ্রাফি জানেন তারা অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। যাদের তাৎক্ষণিক আইডিয়া জেনারেট করার ক্ষমতা আছে তারাও ইন্টারভিউয়ে ভালো করবেন। কারণ অনেক সময় নিয়োগকর্তা তাৎক্ষণিক কোনো বিষয়ের বা পণ্যের ওপর মিডিয়া প্ল্যান চেয়ে বসেন। ভবিষ্যতে যারা ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের জন্য প্রথম পরামর্শ হলো— ছাত্রজীবন থেকেই ব্র্যান্ড রিলেটেড বিষয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাজারে গিয়ে ক্রেতা কী কী বিষয়ে নজর দিয়ে পণ্য কিনছেন সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আজকাল অনেক তরুণ তরুণী ব্র্যান্ড প্রমোটার হিসেবে কাজ করে। আমি মনে করি ভালোবেসে এই কাজটা করলে অন্যদের চেয়ে ব্র্যান্ড মার্কেটিং পেশায় এরা এগিয়ে থাকবে।

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: পিআর, মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং ব্র্যান্ডিং নিয়ে আপনার মতামত?

মুহাম্মদ ফিরোজ আলম : আসলে এই তিনটি কাজ একটির সঙ্গে অপরটি লতাগুল্মের মতো পেঁচিয়ে আছে। একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করা কঠিন। এরপরও যদি আলাদাভাবে বলেন তাহলে আমি বলব ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করাটা আমার কাছে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের। তবুও আমি বলব তিনটি কাজকেই আমি ভালোবাসি অনেক। আসলে যে কোনো কাজেই ভালোবাসা থাকাটা খুব জরুরি। পেশাকে ভালবাসলে পেশাও আপনাকে দুহাত ভরে সাফল্য এনে দেবে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা / ১৭ জুলাই ২০১৯/ এমএম