Menu

নীলুফা আলমগীর  ::‌ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। বিশ্বের বুকে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। নতুন এক মানচিত্র। আর এই জয় ছিনিয়ে আনতে ছেলেদের পাশাপাশি নিজেদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, মুক্তি যুদ্ধে সহায়তা করেছেন, প্রিয় জন্মভূমিকে শুত্রুমুক্ত করছেন অসংখ্য বীর বাঙালি নারী ৷ তবে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ত্যাগী ও দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছেন যাঁরা তাঁদেরই একজন তারামন বিবি বীর প্রতীক৷১৯৫৭ সালে রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তারামন বিবি। তার বাবার নাম আবদুস সোহবান ও মায়ের নাম কুলসুম বিবি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন৷ মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন৷ যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন৷ তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার করে দেওয়ার কথা বলেন। প্রথমে তারামনের মা কুলসুম বেওয়া এই প্রস্তাবে রাজি হন নি৷ একাকী একটা মেয়ে ছেলেদের ক্যাম্পে রান্না করবে, মেয়ের নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তা করেই রাজী হতে পারেনি। পরে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্মমেয়ে হিসেবে গ্রহণ করলে তারামনকে দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন তাঁর মা৷ তখন তারামনের বয়স ছিলো ১৪ বছর৷ কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখান৷

ডয়চে ভেলের সাথে আলাপচারিতায় নিজের সৈনিক হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে জানান যে ঘটনা ছিল ঠিক মধ্য দুপুরের৷ সবাই খেতে বসেছে৷ তারামন বিবিকে পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখার জন্য বলা হলো৷ তারামন সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন৷ হঠাৎ দেখলেন, পাক বাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে৷ সবার খাওয়া বন্ধ৷ দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলেন সবাই৷ তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন৷ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে৷ সেদিন তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন৷ এরপর তারামন অনেক যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ নেন৷ অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান৷

শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয় নানা কৌশল অবলম্বন করে শত্রু পক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে পাক বাহিনীর শিবিরে চলে যেতেন তিনি। কখনও সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তারামন৷ চুল এলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন৷ কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলা ফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী৷ নিজের জীবনের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একমাত্র দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য৷

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তারামন বিবি নামে পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা, তাঁদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, পাকিস্তানি বাহিনীর খবর সংগ্রহ করা এবং সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলেন তিনি। দুর্ধর্ষ সেই কিশোরীর অসীম সাহসিকতার জন্য বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর হাতে তা তুলে দিতে ২২ বছর লেগে যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে প্রথম তার সন্ধান পান। এ কাজে বিমল কান্তিকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।

এরপর নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তারামন বিবির বীরত্বগাথা।অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন। এই খেতাবপ্রাপ্ত মাত্র দু’জন নারীর মধ্যে একজন হচ্ছেন তারামন বিবি।

তারামন বিবিকে নিয়ে আনিসুল হকের লেখা ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’ নামক একটি বই রয়েছে। আনিসুল হক রচিত ‘করিমন বেওয়া’ নামক একটি বাংলা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র তারামন বিবি।তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থায় ভুগছিলেন। ১লা ডিসেম্বর ২০১৮ সালে তিনি নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।

লেখক: নীলুফা আলমগীর

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৪ ডিসেম্বর  ২০২১ /এমএম


Array

এই বিভাগের আরও সংবাদ