প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: দেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে সংকট। রোগী যত বাড়ছে, নানা সংকটও ততই প্রকট হয়ে উঠছে। করোনা রোগীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা অব্যবস্থাপনাও। কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনার কারণে বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা দিয়েছে অক্সিজেন সংকট।
অক্সিজেন সংকটে শুধু চলতি মাসেই দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অন্তত ১৫ জন রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইল ও সিলেটে হঠাৎ আইসিইউ সংকটে দুই করোনা রোগীর মৃত্যু হয়ে বলে দাবি স্বজনদের। এদিকে অব্যাহত রোগী বাড়তে থাকায় আইসিইউ পাওয়া দূরের কথা সাধারণ আসনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়াই দায় হয়ে পড়েছে।
শয্যা সংকটের কারণে দেশের অনেক হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি নেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো হাসপাতালে নির্দিষ্ট আসনের চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হওয়ায় মেঝেতে রেখে চলছে চিকিৎসা। আবার যে হাসপাতালগুলোতে আসন খালি আছে তাও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, সারা দেশে প্রায় ১৫ হাজার শয্যার মধ্যে ৭৫ শতাংশ শয্যা ইতোমধ্যে রোগী ভর্তি আছেন। এমন অবস্থা চলমান থাকলে আগামী সপ্তাহ-দশদিন পর হাসপাতালে আর কোনো শয্যা পাওয়া যাবে না বলে ইতোমধ্যেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, সংক্রমণের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। যে হারে দেশে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে আগামী সাত থেকে ১০ দিন পর আর হাসপাতালে শয্যা পাওয়া যাবে না। দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে সবাইকে বিপদে পড়তে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, রাজধানীর ১৬টি করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালে ৩ হাজার ৭৫৫টি আসনের মধ্যে খালি আছে মাত্র এক হাজার ২৫২টি। আর এই হাসপাতালগুলোতে ৩৯৩টি আইসিইউর মধ্যে খালি আছে মাত্র ৬৬টি। এর মধ্যে ৯টি বড় হাসপাতালে খালি নেই কোনো আইসিইউ।
ঢাকার ২৮টি বেসরকারি করোনা হাসপাতালে এক হাজার ৯৯৪টি সাধারণ আসনের মধ্যে খালি আছে ৫৬৫টি আর ৪৮১টি আর ৪৮১টি আইসিইউয়ের মধ্যে খালি আচে মাত্র ৯৯টি। চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪ সরকারি করোনা হাসপাতালে ৫৩৯টি সাধারণ আসনের মধ্যে খালি আছে ১৫৪টি আর ৩৩টি আইসিইউয়ের মধ্যে খালি আছে মাত্র ১১টি।
বাণিজ্যিক এই নগরীর বেসরকারি আরো ৪ হাসপাতালে ৩৫৫টি আসনের মধ্যে খালি আছে ৯৭টি আর ৩০টি আইসিইউয়ের মধ্যে খালি আছে ১৪টি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাইরে সারা দেশে ১৫ হাজার ৪৮৬টি সাধারণ আসনের মধ্যে খালি আছে মাত্র ৪ হাজার ৯৭১টি। আর ১২৮৭টি আইসিইউয়ের মধ্যে খালি আছে মাত্র ২৮৭টি।
তথ্যমতে, রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল, নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর সদর হাসপাতাল, যশোর বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বরগুনা জেলা সদর হাসপাতাল, সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অন্তত ২০ হাসপাতালে নির্ধারিত আসনের থেকে অধিক রোগী ভর্তি থাকায় মেঝেতে রেখে চলছে চিকিৎসা।
অন্যদিকে রাজধানীসহ সারা দেশে আইসিইউ সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি মুমূর্ষু কয়েক রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করছেন, রোগীর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ার পরও সরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে সিট পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সরকারি হাসপাতাল থেকে নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ পাওয়া যায় না। আইসিইউ পেতে হলে লবিং লাগে। লবিং না থাকলে কোনো অবস্থায় আইসিইউ পাওয়া যায় না। এমন অভিযোগ স্বীকার করেছেন সরকারি কয়েকটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ১০২টি হাসপাতালের মধ্যে ৪৯টিতে আইসিইউ সুবিধা নেই। এর মধ্যে ৩৬টি হাসপাতালই জেলা সদর হাসপাতাল। সম্প্রতি খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে মৃত্যু বেশি হয়েছে। এ দুই বিভাগের ১৮ জেলার মধ্যে ১০টিতেই সরকারি ব্যবস্থাপনার করোনা হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই।এসব জেলা হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট সদর হাসপাতাল এবং খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল ও মাগুরা সদর হাসপাতাল।
আবার কোনো জেলা হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে রোগীদের আইসিইউ তো দূরের কথা, উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেনও দেয়া যাচ্ছে না। যেমন বরিশালের ঝালকাঠি জেলা হাসপাতালে দুটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা আছে। তবে তা কাজে লাগছে না কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায়।
লবিং ছাড়া আইসিইউ পাওয়া যায় না রোগীর স্বজনদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর বড় একটি হাসপাতালের উপাচার্য বলেন, আইসিইউয়ের জন্য হাহাকার লেগেছে। একটি আইসিইউ খালি হলে সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য অন্তত ২০ জন রোগী অপেক্ষমাণ থাকে। সেখানে পছন্দের রোগী ভর্তি করতে মন্ত্রী থেকে শুরু করে হাই প্রোপাইলের লোকজন তদবির করেন। তাদের সবচেয়ে হাইপ্রোফাইলের লোকের পছন্দের রোগীকে ভর্তি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ফলে লবিং ছাড়া সাধারণ রোগীরা আইসিইউ পান না। ফলে তাদের প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আর যাদের টাকা নেই তাদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হয়।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত আইসিইউ চালু হয়নি: গত বৃহস্পতিবার বিকালে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এখনো চালু হয়নি। তাই করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার জন্য অন্যত্র পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শফিকুল ইসলাম জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আইসিইউতে থাকা ১০ করোনা রোগীর ৫ জন অন্যত্র চলে যান। বাকিদের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। যে রোগীদের অবস্থা খারাপ, তাদের ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তার পরও অনেক রোগী আর্থিক সমস্যাসহ নানা অসুবিধার কারণে ঢাকায় না গিয়ে টাঙ্গাইলে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের সাধ্য অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।এদিকে আইসিইউ মেরামত করে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে চালু করা যাবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দিন খান।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৭ জুলাই ২০২১ /এমএম