Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আগামী সোমবার ভোর ৬টা থেকে সারা দেশে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আবার কঠোর লকডাউন জারির ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের ভয়াবহ ‘ডেল্টা ধরন’-এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে করোনা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে ‘শাটডাউন’-এর সুপারিশ পাওয়ার একদিন পরই এমন সিদ্ধান্ত এলো।

শুক্রবার রাতে তথ্য অধিদফতর জানিয়েছে, জরুরি পরিষেবা ছাড়া এসময় সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী যানবাহন ব্যতীত সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে যানবাহন শুধু চলাচল করতে পারবে। জরুরি কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে কেউ বের হতে পারবেন না। গণমাধ্যম এর আওতা বহির্ভুত থাকবে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে সেনাবাহিনীও মাঠে থাকবে। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আদেশ আজ শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা হবে।

এর আগে করোনার ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানী ঢাকার আশপাশের ৭টি জেলায় ৯ দিনের বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। এর একদিন পর ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার রেল ও লঞ্চ যোগাযোগও বন্ধ করা হয়। এছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলাসহ যেসব জায়গায় করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় পৌঁছেছে, সেসব অঞ্চলেও বিধিনিষেধ আরোপ করে স্থানীয় প্রশাসন।

এর আগে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সরকার এ বছর প্রথমে ৫ এপ্রিল থেকে ৭ দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। পরে তা আরো ২ দিন বাড়ানো হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আরো কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। পরে তা আরো ৭ দফা বাড়ানো হয়েছে। এর পর ১৬ জুন একসঙ্গে এক মাস বাড়ানো হয় বিধিনিষেধ। এখন আবার সারা দেশে কঠোর লকডাউন দেয়ার সিদ্ধান্ত হল।

এদিকে দেশজুড়ে ‘শাটডাউন’ দেয়া হচ্ছে- এমন খবরে শুরু হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। শাটডাউনে কী হবে, কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। পাশাপাশি লকডাউন আর শাটডাউনের মধ্যে পার্থক্য কী, ঈদের আগে শুরু হলে কোরবানির পশু কীভাবে বেচাকেনা হবে- এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে মানুষের মাঝে। বিশেষ করে শাটডাউনের খবরে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কপালে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাঁজ।

শাটডাউনের খবরে এরইমধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন মানুষ। সবমিলিয়ে শাটডাউন এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ ঢাকা থেকে দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও বিকল্প উপায়ে ঢাকা ছাড়ছেন তারা। গতকাল শুক্রবার ঢাকার পার্শ্ববর্তী সব ফেরিঘাটেই ছিল উপচেপড়া ভিড়। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও মজুদ করে রাখতে রাজধানীর কাঁচাবাজারসহ সব বাজারেই ছিল মানুষের ব্যস্ততা।

শাটডাউনের খবরে উত্তাপ বেড়েছে রাজধানীর বাজারে। অন্যান্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনের তুলনায় গতকাল শুক্রবার বেড়েছে কেনাকাটা। ধারদেনা করে হলেও, সংকটকাল পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নগরবাসী। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য ছুটির দিনের তুলনায় গতকাল ছিল বেচাকেনার চাপ অনেকটা বাড়তি।

চলাচলে বিধিনিষেধ থাকার পরও মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথ পাড়ি দিয়ে ঢাকার দিকে ছুটছে মানুষ। ঢাকা থেকে গ্রামের দিকে ফেরা মানুষের চাপও রয়েছে। তবে এই নৌপথে ১৫টি ফেরি স্বাভাবিক নিয়মে চলাচল করায় কিছু পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া যাত্রীদের পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না। একই চিত্র দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, নাড়িয়া, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, আরিচা-কাজিরহাটসহ অন্যান্য ফেরিঘাটে।

দেশজুড়ে প্রবল ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় থাকা করোনার লাগাম টেনে ধরতে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য একযোগে সারা দেশকে শাটডাউনের পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এ প্রসঙ্গে প্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত বৃহস্পতিবার বলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সেই অনুযায়ী কাজও করা হচ্ছে। এরইমধ্যে ঢাকার আশপাশের ৭ জেলাসহ দেশের ঊর্ধ্ব সংক্রমিত এলাকাকে স্থানীয়ভাবে লকডাউন দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে তড়িৎগতিতে ঢাকাসহ সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ কিংবা শাটডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়া রয়েছে।

শাটডাউন বলতে কী বুঝানো হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় কারিগরি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, ‘শাটডাউন মানে হচ্ছে সবকিছু বন্ধ থাকবে, শুধু জরুরি সেবা ছাড়া। অফিস-আদালত, বাজারঘাট, গণপরিবহনসহ সব বন্ধ থাকবে। সবাই বাসায় থাকবে।’

তিনি বলেন, জরুরি সেবা বলতে, ওষুধ, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম ছাড়া সবকিছু দুই সপ্তাহ বন্ধ করে মানুষ যদি এই স্যাক্রিফাইস-কষ্টটুকু মেনে নেয়, তাহলে আগামীতে ভালো হবে। নইলে এখন যেভাবে শনাক্ত প্রতিদিন বাড়ছে, সেটা কোথায় যাবে তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।

অধ্যাপক সহিদুল্লাহ বলেন, ‘দিল্লি এবং মুম্বাইতে শাটডাউন দিয়ে ফলাফল পেয়েছে। সেখানে ছয় সপ্তাহ গণপরিবহন বন্ধ ছিল, দিল্লিতে আরো ছিল তিন সপ্তাহ। দিল্লিতে প্রতিদিন এক সময় ২৮ হাজার শনাক্ত হতেন, কিন্তু এখন সেখানে ১৫০ শনাক্ত হচ্ছেন। মৃত্যুও কমে এসেছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারিগরি কমিটির আরেক সদস্য বলেন, গত ২৩ জুন কমিটির বৈঠককালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু প্রতিরোধে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ সারা দেশে ‘কারফিউ’ জারি করার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। তবে গত বৃহস্পতিবার কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সহিদুল্লাহ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সারা দেশে ১৪ দিনের শাটডাউনের পরামর্শ করা হয়।

কমিটির আরেক সদস্য বলেন, লকডাউন শব্দটি এখন হেলাফেলার হয়ে গেছে। লকডাউনের মধ্যেও গণপরিবহন চলছে, মার্কেট শপিংমলসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। এ কারণে তারা ‘কারফিউ’ শব্দটি প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারফিউ হোক আর শাটডাউন হোক, সারা দেশে আগামী ১৪ দিনের জন্য যানবাহন ও মানুষের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এমনকি চিকিৎসাসেবা বন্ধের উপক্রমও হতে পারে হাসপাতালে।

শাটডাউন কিংবা কঠোর পদেক্ষপ নেয়ার পর তা যদি ঠিকমতো বাস্তবায়ন না করা হয় তাহলে কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অতীতে দেখেছি লকডাউন দেয়া হয়েছে কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। কেবল হুকুম জারি হচ্ছে। এভাবে কাজ হবে না। এখন যে সিদ্ধান্তই আসুক তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

ফেরিঘাটে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় : শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাংলাবাজার ঘাট এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর নানা প্রান্ত থেকে আসা ঢাকামুখী মানুষের ভিড়। ঘাটে আসা যাত্রীরা বেশির ভাগই এসেছে মাহিন্দ্র, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার থ্রি-হুইলারে করে।

এসব যানবাহনে গাদাগাদি করে আসা যাত্রীরা ঘাটের টার্মিনালে নেমে চলে যাচ্ছে ফেরিঘাটের পন্টুনে। কিছুক্ষণ পন্টুনে অপেক্ষা করেই তারা ফেরিতে উঠতে পারছে। অনেকেই আবার পন্টুনে আসামাত্রই ফেরি পাচ্ছে। ২৫ টাকার ভাড়ার একটি টিকিট কেটে যাত্রীরা ফেরিতে উঠে পড়ছে। ফেরি পাওয়া নিয়ে যাত্রীদের কোনো দুচিন্তায় পড়তে হচ্ছে না। ঘাটে আসা কিছু যাত্রীর মুখে মাস্ক দেখা গেলেও অনেকে মাস্ক ব্যবহার করছে না। দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও ট্রাফিক পুলিশও অনেকটা গাছাড়া। ঘাট এলাকায় লকডাউন নিয়ে তাদের নেই কোনো প্রচার-প্রচারণা।

ফেরি পারাপারের জন্য প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসও বাংলাবাজার ঘাটে আসামাত্রই ফেরিতে উঠতে পারছে। তবে ঢাকামুখী যাত্রীদের কিছুটা চাপ থাকায় ফেরিতে পণ্যবাহী ট্রাক চাহিদা অনুযায়ী পারাপার করা হচ্ছে না। ফলে বাংলাবাজার ঘাটের টার্মিনালে আটকা পড়েছে দুই শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক।

বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক জামিল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের ১৫টি ফেরি উভয় ঘাট থেকে যাত্রী ও জরুরি প্রয়োজনে আসা যানবাহন পারাপার করছে। উভয় দিকেই যাত্রীর চাপ আছে। ঢাকায় যেমন মানুষ যাচ্ছে, তেমনি ঢাকা থেকে গ্রামে ঢুকছে। সব ফেরি চলায় ঘাটে অতিরিক্ত চাপ নেই।’

স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঘাটে আসা এত মানুষকে বলে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে মাস্ক পরে ফেরিতে ওঠাতে। মানুষ নিজে থেকে সচেতন না হলে মাইকিং বা প্রচারণা করেও লাভ নেই।’

বাংলাবাজার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) জামালউদ্দিন বলেন, ‘মানুষকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। তারা নানা উপায়ে ঘাটে চলে আসছে। ঘাটে আসা থ্রি-হুইলারগুলো ঠেকাতে তাদের চাবি নিয়ে যাচ্ছি, মামলা দিচ্ছি। আমাদের চোখে পড়ামাত্রই মাইক্রোবাস, বাসসহ যাত্রী বহন করা গাড়িগুলো ধরে রাখা হচ্ছে। গত তিন দিনে ১৩টি মামলা আমরা দিয়েছি। এর ফলে গত দ্ইু দিনের তুলনায় আজকে এসব গাড়ির চাপ কমে আসছে। আরো কমে আসবে।’

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৬ জুন ২০২১ /এমএম

 


Array

এই বিভাগের আরও সংবাদ