বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি :: গামছা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একটি অপরিহার্য এবং বহুল ব্যবহৃত কাপড়। যা গোছলের পর বা হাত মুখ ধোয়ার পর মোছার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই ‘গা মোছা’ থেকেই এর নাম হয় গামছা। গামছার কথা বলতে গিয়ে, এর সাথে সামঞ্জস্য একটি ঘটনা মনে পরে গেলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় আট মাস গ্রামে কেটেছে আমার। আমাদের গ্রাম বেশ আধুনিক। সেখানে আধুনিক নিউ মার্কেট না থাকলেও বাজারে মনোহারী সহ বিভিন্ন ধরনের দোকান ছিল।
সেখানে একটা বেশ আধুনিক জুতার দোকান ছিল। যেখানে গেলে নতুন জুতা পড়ার আগে পা মুছে দেবার লোকও ছিল। যে লোকটি পা মুছে দিত তার সঠিক নাম আমরা জানতাম না। সবাই তাঁকে ‘পামছা’ বলে ডাকতো। কি সুন্দর মিল গা মোছা থেকে যেমন গামছা, পা মোছা থেকে পামছা।
অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সবাই স্কুল কলেজ ও যার যার কর্ম স্থলে ফিরে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন অফিস। সবকিছুই নিজের মনে হয়। এভাবে অনেকদিন কেটে গেলো। তারপরও গ্রামে যাওয়া হয়েছে অনেকবার কিন্তু ঐ জুতার দোকান সম্পর্কে অনেক কৌতূহল থাকলেও জুতার দোকানে আর যাওয়া হয় নাই। তাছাড়া জুতা কেনার জন্য তো আর গ্রামে আসা হয় না।
গ্রামে কত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আছে তাদের সাথেই সময় কেটে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব শেষ করে গ্রামে গেলাম কিছুদিন থাকব। দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের গ্রাম আরও আধুনিক গ্রামে পরিণত হয়েছে, যেখানে ব্যাংক, পোস্ট অফিস, মাদ্রাসা উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় সবই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । শৈশবে দেখা বাজারে ঐ জুতার দোকানের কথা মনে হতেই সে দোকানটিতে গেলাম, তার জৌলুস আগের মত আর নাই। স্বাধীনতার পর গ্রামের লোকজন গ্রাম ছেরে শহর বা বিদেশে পারি জমিয়েছে।
তখন গ্রামের যুবকদের একমাত্র লক্ষ্য মিডলইস্টে গিয়ে অর্থোপার্জন। সে সময় ছিল আদম ব্যবসায়ীদের রমরমা অবস্থা। জমিজমা বিক্রি করে হলেও বিদেশ গিয়েছে উন্নত জীবযাপনের আশায়, অনেক প্রতারিত হয়েছে আবার অনেকে, রোজগার করে দ্বিগুন জমিজমা কিনে স্থায়ীভাবে গ্রামে বসবাস শুরু করেছে। বিদেশ থেকে জুতা জামা কিনে পাঠাচ্ছে স্বজনদের জন্য, তাই ক্রেতা কম। ব্যাবসা মন্দা।
আমার চোখ খোঁজে পামছাকে। কিন্তু অনেক খুঁজেও পামছাকে দেখলাম না। দোকানির বয়সও অনেক বেড়ে গেছে। আমি তাঁকে জিগ্যেস করলাম, ‘কেমন আছেন চাচা’? উনি খুব খুশী হয়ে বললেন, কেমন আছো বাবা? আমাদের কি ভুলেই গেলে’? আমি বললাম, ‘ভুলে গেলে কি আর আসতাম’। এদিক ওদিক তাকিয়ে পামছাকে দেখতে না পেয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘পামছা কই’? দোকানের মালিক বললেন, ‘ও কি আর পামছা আছে! হজ্ব করে এখন ‘হাজী আব্দুল লতিফ’। ছেলেকে জমি বিক্রি করে সৌদিতে পাঠাইছিলো তার ছেলে বেশ ভাল আয় করে দেশে বিক্রি করা জমির দ্বিগুন জমি কিনেছে, বাবাকে হজ্ব করিয়েছে। আমি বললাম, ‘বাহ বেশ’!
আমার শুনে খুবই ভাল লেগেছিল। কারন ছেলেবেলায় ওর পামছা নামটা সবার জন্য আনন্দের হলেও ওর কাছে নিশ্চয় আনন্দের ছিল না। হাজি হয়ে অন্তত সন্মান জনক একটা যায়গায় নিজেকে দাড় করাতে পেরেছে। কিন্তু দোকানী চাচার কথা শুনে আমি হতভম্ব! উনি বললেন, ‘হাজী হলে কি হবে, পামছা নাম তো আর ঘোচাতে পারল না। তার আসল নামে কেউ ডাকে না, এখন সবাই বলে ‘পামছা হাজী’।
পামছা তার নাম পরিবর্তন না করেই একদিন না ফেরার দেশে চলে গেলেন। গামছার নাম পরিবরতন হয় নি, কিন্তু তার স্থান থেকে অনেকাংশে অপসারিত হয়েছে তোয়ালের দ্বারা। হয় গামছা খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে তোয়ালের আকার ধারন করেছে কিংবা হত দরিদ্র গামছাকে তোয়ালে তার আভিজাত্য দিয়ে জোর করেই সরিয়ে দিয়ে তাঁর স্থান প্রায় সব ক্ষেত্রেই দখল করে নিয়েছে।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আগে গ্রামের লোকেরা পুকুর বা নদীতে গোসল করতে যেতো ঘাড়ে গামছা ঝুলিয়ে, এখন তোয়ালে জড়িয়ে গোছলে যায়। বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল হয়েছেন এবং যার কারনে গ্রামে সবাই যাদের মান্যি গন্যি করেন তারা সবাই গামছার ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে তোয়ালে ধরেছেন। আবার শীতকালে অনেককে দেখা যেত চাদরের পরিবর্তে গায়ে একটা তোয়ালে জড়িয়ে রাখতে। ভাবখানা তার একটা তোয়ালে আছে।
শুধু গামছাই না অনেক কিছুই তার স্থান হারিয়েছে। যেমনটি বিড়ির বদলে সিগারেট, স্পঞ্জের স্যান্ডেলের পরিবর্তে টায়ার কাটা স্যান্ডেল। কিংবা স্বাধীনতার বদৌলতে কিছু লোকের বেশ অর্থের সমাগম হয়েছে তারা তো আরা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরতে পারে না তাই জুতা পরে। এই জুতা পড়াটাও কেমন জানি অদ্ভুত। দামি লুঙ্গির ও দামি আদ্দির পাঞ্জাবীর সাথে মচমচে জুতা। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ও সামাজে নিজের অবস্থানের সাথে মিল রেখে সব কিছুই পরিবর্তন হয়। ডারউইনের মতে বানর প্রজাতির বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের রুপ নিয়েছে। তাই যদি হয়
তাহলে গামছার বিবর্তনে তোয়ালে হবে না কেন ? তবে গামছার বিবর্তন ঠিক প্রাণীর মত না। অনেকটা দখলদারির মত। আভিজাত্য যেমন গ্রাম বাংলার মুল সংস্কৃতি দখল করেছে, তোয়ালের দখলটাও ঠিক তেমনি একটা ব্যাপার। বাংলাদেশে তোয়ালের ব্যবহার আর সামাজিক মর্যাদা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সমাজের শ্রেণি নির্ধারনের ক্ষেত্রে তোয়ালের ভুমিকা অপরিসীম।
আমার সব সময়ই একটা ধারনা ছিল, তোয়ালে মূলত একটা রাথরুমের অপরিহার্য উপাদান। সরকারী বা আধা সরকারী অফিসে দেখতাম সব কর্মকর্তার চেয়ারে ঝুলছে শাদা-নীল ডোরাকাটা তোয়ালে। ছাত্র জীবনে এর মাহাত্ম বুঝি নাই কখনই। সবচাইতে অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো সেই তোয়ালে মাসের পর মাস না ধুয়ে চেয়ারের পেছনে ঝুলে থাকে। অনেক অফিসেই দেখেছি অনেক কর্মকর্তার তোয়ালের আসল রঙ জ্বলে গিয়ে ফ্যাঁকাসে রঙ ধারণ করেছে। রঙ যাই হোক না কেন চেয়ারের পেছলে তোয়ালে ঝুলাতেই হবে। ঠিক যেমন, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়। সেরকম তোয়ালেই কর্মকর্তা বা কর্মচারী চেনার একমাত্র সনদ।
সে যা হোক, তোয়ালে যে সামাজিক মর্যাদার একটি বড় উপাদান তা আবার দেখলাম আমি যখন আমার কর্ম জীবন শুরু করলাম তখন। অফিসের প্রথম দিনেই দেখলাম আমার অফিস কক্ষ বেশ গুছানো। কিন্তু আমার চেয়ারের পেছনে লম্বা একটা শাদা নীল ডোরাকাটা তোয়ালে দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমাদের অফিস বিষয়ক কর্মকর্তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার চেয়ারের পেছনে তোয়ালে কেন’?
উত্তরে ভদ্রলোক আমার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে বললেন, ‘বলেন কি স্যার!! তোয়ালে অফিসের কর্মকর্তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ’! আমি তাঁকে আমার তোয়ালে বাথরুমে রাখার ব্যবস্থা করার জন্য বললাম। কর্মকর্তা আমাকে মূর্খ ভাবলেন কিংবা আধুনিক সমাজ সাথে আমার কোনও সম্পৃক্ততা নেই ভেবে আমার দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকালেন। অনিচ্ছা স্বত্বেও অফিসের পিওনকে নির্দেশ দিলেন আমার তোয়ালে বাথরুমে রাখার।
এবং আমার আড়ালে সবাইকে বলতে লাগলো আমার সম্পর্কে। কোথা থেকে একটা ক্ষ্যাত এসছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে চেয়েরারে পেছনে তোয়ালে না রাখার একটা ফল তখন পেয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু মেজরের স্ত্রী আসলেন কিছু সিরামিক্সের তৈজসপত্র ক্রয় করতে। কিছুক্ষণ পর আমি রুমে আসলে, উনিও আমার পেছনে ঢুকে পরলেন, বললেন, কেমন আছেন ভাই’? আমি একটু অবাক হয়েই জিগ্যেস করলাম, ‘কখন এলেন’? আমার বন্ধু আসে নাই’? ভদ্র মহিলা বললেন, ‘ও তো আপনার কাছেই আসতে বলেছিল, কিন্তু আপনার রুমে ঢুকে দেখি আপনি নাই, তিনি প্রথম থেকে সব কিছু বর্ণনা করলেন।
আমাকে রুমে না পেয়ে পাশের কর্মকর্তার রুমে গিয়ে আমার পরিচয়ে কিছু অর্ডার করলেন। অর্ডার করে তার রুমে অপেক্ষা করছেন। অনেক্ষন অপেক্ষা করার পর বললেন, ‘এত দেরি কেন? একটু তাড়াতাড়ি করেন ভাই। কর্মকর্তা বললেন, সব রেডি স্যারের একটা সই এর অপেক্ষায় আছি, উনি কারখানার ভেতরে আছেন, এলেই হয়ে যাবে। ভদ্র মহিলা একটু অধৈর্য হয়েই বললেন, ‘আপনি সই দিলেই তো হয়ে যায়, কোন সাহেবের আবার সই লাগবে’? পাশের রুমে আমার বস, ওনার সই লাগবে, যেহেতু কারখানা থেকে কোনও মালামাল সাধারণ ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয় না তাই যে কোনও মাল কারখানা থেকে বের হলে তার অনুমতি লাগবে।
আপনি তার পরিচিত বলেই আমি আপনার অর্ডার নিয়েছি। উনি সবচে মজার কথা বললেন, আপনার চেয়ারে তোয়ালে না দেখে পাশের রুমে ঢুকে দেখলাম ওনার চেয়ারের পেছনে একটা বড় তোয়ালে ঝুলছে, তাছাড়া উনি আপনার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তাই ভাবলাম উনি হয়তো আপনার বস, কিন্তু বুঝতেই পারি নাই যে আপনিই সবার বস। হায়রে তোয়ালে! ভাগ্যিস চেয়ারের পেছনে গামছা রাখার ব্যবস্থা ছিল না।
আমার কর্মস্থলে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে ক্রেতারা আসতেন। আর আমি যেহেতু উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের প্রধান ছিলাম তাই তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল বেশী। প্রথম যখন একজন ক্রেতা আমার দপ্তরে এলেন, এসেই তার নজর গেলো আমার অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তাদের চেয়ারের দিকে। আমাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘সবার তোয়ালেগুলো বাথরুমে না রেখে চেয়ারের পেছনে কেন’ ?
আমি একটু বিব্রত হয়ে বললাম, ‘তুমি চিন্তা করে দেখ, আমাদের এখানে ওয়াশরুমের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেশী। তাই এগুলো যদি সব ওয়াশরুমে রাখা হয়, তাহলে ওয়াশরুমকে তো মনে হবে একটা তোয়ালের দোকান, তাই না”? সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলো। বলেছিল, ‘তুমি খুব ফানি’।
তোয়ালে বিড়ম্বনায় আমার এক বন্ধুকেও পরতে হয়েছিলো। একবার সে সোনালী ব্যাংকে গেলো একটা কাজের জন্য। যে টেবিলে কাজ ছিল সেখানের কর্মকর্তা অনুপস্থিত ছিলেন। তাই সে টেবিলের সামনের চেয়ার খালি পেয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকল। কিছুক্ষন পর ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এলেন, বেশ রাগান্বিত স্বরে বললেন, ‘কি চাই’? বন্ধুটি বলল এই টেবিলের কর্মকর্তার কাছে আমার কাজ আছে, তাই অপেক্ষা করছি। সব শুনে বললেন উনি আজ নাই, ‘আমি তার সহকর্মী, আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি। কিন্তু আপনি আমার চেয়ারে বসেছেন কেন’?
বন্ধুটি অবাক হয়ে বলল, ‘আমি তো টেবিলের এই পাশে আপনার চেয়ার তো ওই পাশে’! কর্মকর্তা বললেন, ‘না ওইটা আমার বসের চেয়ার আমি তার উলটা দিকে বসে কাজ করি’। বন্ধুটি বললেন, “ঠিক আছে বসেন না এখানে চেয়ার তো আরও আছে, তাছাড়া এই চেয়ারে তো আর আপনার নাম লেখা নেই’। উত্তরে কর্মকর্তা বললেন, ‘দেখছেন না আপনি যে চেয়ারে বসেছেন তার পেছনে একটা তোয়ালে দেওয়া আছে’ ! তাঁদের ধ্যান জ্ঞ্যান অনেকটা এমনই “আমি চির তরে এই অফিস ছেরে চলে যাব, তবুও তোয়ালে পারিবনা ছাড়িতে।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/৩১ অক্টোবর ২০২০/এমএম





