Menu

বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা :: ভারত উপমহাদেশে কফির চেয়ে চায়ের প্রচলন ছিল বেশী। এদেশে ইংরেজরা তাঁদের শাসনামলে সিলেটে চা গাছের সন্ধান পায় এবং পরবর্তীতে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ শুরু করে। ছোট বেলায় শুনতাম, ইংরেজরা এদেশের লোকদের প্রায় বিনামূল্যে চা বিতরন করতো। তারপর যখন তারা চায়ে অভ্যস্থ হয়ে পড়লো তখন এর মুল্য নির্ণয় শুরু হলো। সেই জন্যেই বাংলাদেশে চায়ের কদর অনেক বেশী। তখন কফি সাধারন জনগণ চিনত না। আর সাধারন জনগন হিসেবে আমিও চায়ের ভক্ত ছিলাম।

কফি বাংলাদেশে এখন বেশ জনপ্রিয়, গরিব, বড় লোক কিংবা ফকিরেরও পছন্দ। ফকিরেরে কথায় একটা কৌতুক মনে পরে গেলো। কৌতুকটা সবারই জানা। তবুও বলছি, এক ফকির ভিক্ষা চাইলো, স্যার দশটা টাকা দিবেন?
দশ টাকা কেন? দশ টাকা দিয়ে কি করবি?
স্যার কফি খামু।
কফির দাম তো পাঁচ টাকা
স্যার দুই কাপ কফি লাগবো
কেন দুই কাপ কেন?
আমার গার্লফ্রেন্ডও খাইবো স্যার।
এই ব্যাটা! ফকির হইয়া আবার গার্ল ফ্রেন্ডও বানাইছ!
না স্যার, গার্ল ফ্রেন্ডই আমারে ফকির বানাইছে।

আমাকে অবশ্য কেউ ফকির বানায় নি। কিন্তু কফি পানের অভ্যেস করে ফেলেছি তাও আবার ব্ল্যাক কফি। তাই আমার প্রতিদিনের কাজ শুরু হয় এক কাপ ব্ল্যাক কফি দিয়ে। ব্ল্যাক কফির প্রথম চুমুকেই শরীর হালকা হয়। ব্ল্যাক কফি পানের অভ্যেস আমার অনেক দিনের।
এবার গল্পটা শুরু করা যাক। অনেক আগের কথা । জীবনের প্রথম চাকুরীর সুবাদে জাপান গিয়েছিলাম এক বছরের প্রফেশনাল ট্রেইনিং এ। ব্যাঙ্কক থেকে আট ঘন্টার একটানা ফ্লাইটে যখন ধৈর্যের শেষ সীমায় ঠিক তখনই বিমান অবতরণের সুসংবাদ ঘোষণা দিল সুললিত কণ্ঠে কোন এক বিমানবালা।
আলো ঝলমল ওসাকা বিমান বন্দরে অবতরণের পর দেখি আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাড়িয়ে আছে এক জাপানি তন্বী তরুণী। আক্ষরিক অর্থে কাঁচের বাক্সবন্দী জাপানী পুতুলের মত। অবশ্য ওই সময় বয়সটা এমনি ছিল যে, সব মেয়েকেই বিশ্ব সুন্দরীই মনে হতো। আমিও তখন বয়সে তরুন এবং খুবই পুলকিত বোধ করেছিলাম। কুশল বিনিময়ের পর তার নাম জানলাম চিজুরু। আমাকে বলল, তুমি এখানেই অপেক্ষা কর, আমি শিনকানসেনের টিকেট নিয়ে আসি, আমাদের নাগোয়া যেতে হবে ট্রেনে করে। তারপর বলল, তুমি কি চা বা কফি নিবে? আমি চা পানেই অভ্যস্ত কফি দু একবার যাও বা পান করেছি আমার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি। কেন জানিনা কি এক দুর্বার আকর্ষণে কফির কথাই বললাম। ও বলল, ‘কি ধরনের কফি নিবে’? বলে কি কফির আবার ধরন আছে না কি! চায়ের ধরন তো তেমন নাই। রঙ চা আর খাটি গরুর দুধের চা। আবার ভুল বললাম। গরু তো সবসময়েই খাটি, কথাটা ‘হবে গরুর খাটি দুধ’। যা হোক কফির ধরন আছে শুনে মহা বিপদে পড়লাম, একে তো কফি পানের অভ্যেস নেই তার উপর এই অদ্ভুত প্রশ্ন। জাপানি তরুণরা কি ধরণের কফি পান করে তা বের করার জন্য বললা, ‘তোমাদের দেশের ছেলেরা কি ধরনের কফি পান করে’? চিজুরু বলল, ‘ব্ল্যাক কফি’। বাহ কি সুন্দর নাম ব্ল্যাক কফি। কালো কফি! তা সে যতো কালোই হোক এমন আকর্ষণীয় জিনিষ পান করতেই হবে। এ কালো যেন রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতার মতোই। কবিগুরু কালো মেয়ের এত সুন্দর বর্ণনা করেছেন আর আমি চিজুরুর অনুরোধে তার ফর্সা হাতের কালো কফি খেতে পারবো না! এ কেমন কথা! অগত্যা আর কি করা, তাছাড়া নিজেকে হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ কফি পান করতেই হবে। তাছাড়া চিজুরুর কাছে নিজেকে হিরো বানানোর প্রচেষ্টায় তখন আমি ব্যস্ত। সে কারনেই বোধহয় ব্ল্যাক কফির মাহাত্য না বুঝেই তাকে বললাম, ‘ঠিক আছে ব্ল্যাক কফিই দাও’। বেশ পুলকিত হয়ে কালো কফির জন্য অপেক্ষা করছি। চিজুরু ভেন্ডিং মেশিন থেকে কাগজের মগে আমাকে কফি কিনে দিলো। আমি আরও পুলকিত হয়ে কফিতে চুমুক দিলাম। আঁতকে উঠলাম! মনে হলো যেন চেরতার পানি খাচ্ছি। ব্ল্যাক কফি এতো তিতা হয়? চিজুরু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেজন্য তিক্ততার প্রভাব মুখে পরতেই দিলাম না। নায়কের মতোই মুখে স্বাভাবিক হাসি রেখে বললাম দারুন স্বাদ! এর প্রতিউত্তরে মেয়েটি আমাকে একটি মিষ্টি হাসি উপহার দিল। তাতে আমার হৃদয় বিগলিত হয়ে ব্ল্যক কফির সব তিক্ততা মধুর মত মনে হলো। তারপর টিকেটের লাইনে দাঁড়ালো। হাসি যত মধুরই হোক না কেন, আমার পক্ষে এ বিস্বাদ কফি পান করা সম্ভব না। আমিও সুযোগ বুঝে কফি ভর্তি মগটা ফেলে দিলাম গারবেজে।

ব্ল্যাক কফি ভাল লেগেছে বলেছি তারপর খারাপ লাগা বলা খুব কঠিন। সুতরাং ট্রেইনিং এর যায়গায় প্রতিদিন সকালে চা বা কফি বিরতির সময়। আমাকে সে কালো কফি দিতে শুরু করলো। কিছুটা ভদ্রতা করে, (আমার মনে হয় তাকে খুশি করার জন্য, না না শব্দটা ঠিক খুশী হবে না এটা হবে আকৃষ্ট) নিয়মিত ব্ল্যাক কফি পান করতে করতে অভ্যেসে দাড়িয়ে গেলো একদিন। সেই সুবাদে এখনো সকালের যাত্রা শুরু ব্ল্যাক কফি দিয়ে। স্থান কাল পাত্র সব বদলিয়েছে, অভ্যেস বদলায় নি। এত গেলো ব্ল্যাক কফি পানের ইতিহাস। চিজুরুর সাথে যখন রেলগাড়িতে যাত্রা করতেই যাচ্ছি তখন বাকি কথা না বললে আমার এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
কিছুক্ষণ পর টিকেট নিয়ে ফিরে আসলো চিজুরু। বলল, চল। আমি মনে হয়ে তাঁর আগমনের অপেক্ষায়ই ছিলাম। বলার সাথে সাথেই তড়িৎ গতিতে হাঁটা শুরু করলাম, ওর আগে আগে, ও তখন জিগ্যেস করলো, কোন দিকে যেতে হবে জানো? আমি বোকার হাসি দিয়ে মাথা নাড়লাম। তারপর গতি কমিয়ে ওর পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলাম। তবে যতটা সম্ভব সিনা টান করে। স্মার্টনেসের একটা ব্যাপার আছে না! আমার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ আর চাকা লাগানো স্যুটকেস টেনে নিয়ে হাঁটছি। একদম ইংরেজি ছবির নায়কের মতই ভাবছিলাম নিজেকে। কেন ভাববো না! পাশে তো নায়িকা আছেই। আমরা যে ট্রেইনে উঠবো তাঁর নাম “সিনকানসেন”। খুবই দ্রুত গতি সম্পন্ন। ঘণ্টায় ২৩০ কিঃমিঃ গতি (সে সময় ট্রেনের গতির কথা বলছি, এখন আরো বেড়ে গিয়েছে)। জাপান আসার আগে এই ট্রেইনের নাম শুনেছি। তাই এই ট্রেইনের ভ্রমন আনন্দে খুব উৎফুল্ল ছিলাম। তাঁর চেয়ে বেশি উৎফুল্ল ছিলাম চিজুরুর সাথে বসে অন্তত দুই ঘণ্টা ভ্রমন করার আনন্দের অলিক কল্পনার রঙ মাখানো রোমান্সের কথা ভেবে। কি বলছি যা তা! রোম্যান্সের বাংলা সহজ অর্থ প্রেম বা প্রেম সংক্রান্ত। কিন্তু আমি তো প্রেমে পড়ি নাই। তবে এর অন্য ভাবেও অর্থ করা যায়। যেমন, কোন মানুষের প্রতি আবেগপূর্ণ আকর্ষণ যদি শেষ পর্যন্ত ভাবপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক হয়ে দাড়ায় তাহলে তাকেও রোম্যান্স বলা যেতে পারে। আমার মনে হয় পরের সংজ্ঞাই আমার জন্য ঠিক ছিল তখন। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমি চিজুরুর সাথে কথা না বলে কল্পনার স্বপ্ন রাজ্যে বিচরণ করছি। মুহূর্তেই বাস্তবে ফিরে এলাম, ওর সাথে গল্প শুরু করলাম। মেয়েটাও যে খুব আলাপী তা মনে হলো না। অথবা এও হতে পারে যে ভাষার প্রতিবন্ধকতা। তাঁর পরেও ভাঙ্গা ইংরেজি ও জাপানীর মিশ্রণে অদ্ভুত দ্রবন বানিয়ে আমরা কথা চালিয়ে গেলাম। ইংরেজিতে যে আমি খুব পারদর্শী তাও না। তবে ওর চেয়ে ভাল বলি। আর ওর ইংরেজি বোঝাও ছিল আমার জন্য গবেশনা মুলক। আমরা যেমন শব্দের শেষে ব্রেক করতে পারি, ওরা পারে না। যেমন প্রেজেন্ট বলতে পারে না কারন ব্রেক নাই। তাই বলে “প্রেজেনতো”। ব্ল্যাক কফিতে অভ্যস্ত হতে সময় লেগেছিল মাসাধিক, কিন্তু চিজুরুর ইংরেজিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আরেকটা মজার ব্যাপার হয়েছিলো সেটা অবশ্য আরও কিছুদিন পর। জাপানী ভাষায় ‘ল’ নাই তাই ওরা ‘ল’ কে ‘র’ উচ্চারণ করে। আমি জাপান যাবার মাসখানেক পর বাংলাদেশ থেকে গোলাম মাওলা নামে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তার নাম হয়ে গেলো মাওরা। ভদ্রলোক তো মহা ক্ষ্যাপা। কি আর করা জাপানের বাকীটা জীবন তাকে মাওরা নাম নিয়েই থাকতে হয়েছিলো। তবে মাওলা ভাই অত্যন্ত ভালো লোক ছিলেন। তাকে নিয়ে পরে লিখবো।

যা হোক, ট্রেইন এসে গেলো। একদম ঝকঝকে। মনে হচ্ছে এই মাত্র নতুন বানিয়েছে। উঠার দরোজার সামনেই লাগেজ রাখার জায়গা। ব্যাবস্থা দেখে চিন্তিত হলাম। যে কেউ নিজের মনে করে আমার ব্যাগ নিয়ে নেমে যেতে পারে। মনে দ্বিধা নিয়ে দরজার পাশে ব্যাগ রেখে ভিতরে গিয়ে জানালার পাশে বসলাম, পাশে চিজুরু। কিন্তু আমার মন পরে রইলো দরজার পাশে রাখা স্যুটকেসের দিকে। কেউ যদি নিয়ে নেমে যায়? সে ভয়। তাই মাঝে মাঝে বাথরুমের নাম করে ব্যাগ পরিদর্শন করতে লাগলাম। এতে একটা সমস্যা দেখা দিলো, চিজুরু বলেই ফেললো, তোমার এই রোগ তা কত দিনের? আমি ভাবলাম আমার সন্দেহের কথা বলছে। আমি কথা এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা আমাকে বলতেই লাগলো। ডায়াবেটিস যদি ছোট বেলা থেকেই হয়ে থাকে তাহলে জাপানে এর ভালো চিকিৎসা আছে। হায় আল্লাহ! আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, ‘না না আমার ডায়াবেটিস নাই’। ও বললো, ‘তাহলে এতো ঘনঘন বাথরুমে যাচ্ছ কেন’! আমি বললাম, ‘কফি পান করেছি তো তাই’। সে বললো, ‘তুমি তো কফি পান করো নাই। আমি দেখলাম তুমি ওটা গার্বেজ করে দিয়েছো’।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০/এমএম


Array