বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা :: একটা প্রবাদ আছে ‘যাহা রটে তাহা কিছুটা বটে’ । রটনা যে সবসময় কুৎসা হয়, তা না। মানুষ মিথ্যা কল্পনার মাধ্যমে রটনা করে। মিথ্যা রটনায়ই যেন সর্ব সুখ, কে রটিয়েছে সেটা বিষয় না, বিষয় হচ্ছে রটনা বাতাসের আগে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় । আর তার সাথে রং মাখিয়ে গল্পটি রসে টইটুম্বুর করে ফেলে। যেমন বলা হলো একটা লোক বাতাসের মধ্যে হাটছিলো তার লুঙ্গিটি বাতাসে হাঁটুর উপরে উঠে গিয়েছিলো। এ কথা বাতাসের গতি বুঝানোর জন্য বলা হলো। সেই গল্পটি মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তন হয়ে এমন দাঁড়ালো, একটা লোক বাতাসে হাটছিলো হটাৎ তার লুঙ্গিটি খুলে বাতাসে উড়তে লাগলো, লোকটি প্রানপনে লুঙ্গির পেছনে দৌড়াতে লাগলো।
একটি কুৎসা রটনাকে ঘটনায় যখন প্রচার হয়, তখন সবাই বিভ্রান্ত হয়ে মিথ্যাকেই গ্রহণ করে এবং মুড়ি-চানাচুরের মত মুখরোচক খাবারে পরিণত করে। কুৎসা রটনা সবসময়ই সমাজে গ্রহণ যোগ্য।
আমরাও আমাদের ছাত্র জীবনে, মজা করার জন্য একটি ঘটনাকে রঙ চঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করতাম। একবার গল্পের ছলে আমাদের এক বন্ধু মোহিতুজ্জামান কালু (বন্ধুটি ছিল খুবই ফর্সা, কিন্তু তার নাম কেন কালু রাখা হয়েছিল আজ অব্দি আমার মাথায় আসেনা) সাপ আর সুচোর গল্প করেছিল। তাঁর ভাষ্য মতে গল্পটি ছিল এমন। ‘সে দেখেছে একবার একটি সাপ জীবন্ত সুচো খেয়ে ফেললো’। আমার আরেক প্রিয় বন্ধু মাসুম গল্পটিতে মনে হয় বেশ মজা পেয়েছিল, ‘তাই যেখানেই বন্ধু সমাগম বা বন্ধুদের আড্ডা তখন মাসুম কালু কে বলতো, দোস্ত তোর সাপ আর সুচোর গল্পটা আরেকবার বল না, খুব ভালো গল্প শোনো তোমরা এখন কালুর নিজের দেখা একটি গল্প’। কালুর ফর্সা মুখ যেন দুধে আলতায় মিশে গোলাপী হয়ে যেত। ঠিক আছে তোর আর লজ্জা পেতে হবে না আমি বলছি। মাসুম কালুর সাপের-সুচোর গল্পে রঙ আর রস মিশিয়ে বললো, আমাদের দোস্ত কালু দেখেছে সাপ সুচো খেয়ে ফেললো, তা দেখে নাকি কালুর তার মনে দয়া হলো। তখন সে একটি ছুরি এনে সাপের পেট বরাবর কোপ মারলো আর তখনি সুচো সাপের পেট থেকে দৌড়ে পালালো। পরবর্তীতে ছোট্ট ঘটনায় যখন রঙিন প্রলেপের স্তর জমতে থাকলো, এবং দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো তখন কালু আক্ষেপ করে বলেছিলো, ‘ইশ ক্যান যে সাপরে সুচো খাওয়াতে গেছিলাম’।
আমার ছেলে বেলা থেকেই শুনে আসছি মিথ্যা রটনার নানা রকম ঘটনা। সেই সব আজগুবী গল্প মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম। ছেলেবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, বছরান্তে পরীক্ষা শেষে বেড়াতে যেতাম নানা বাড়ি। আমার আব্বার কোনো ভাইবোন বেঁচে না থাকায় আমরা নানা বাড়ির সাথেই সম্পৃক্ত ছিলাম। মামাতো-খালাতো ভাই বোন নিয়ে হৈহুল্লোড় করে বিশাল আনন্দ হতো। আমাদের গ্রামে কিছু লোক ছিলেন তাদের সম্মন্ধে আমাদের খারাপ ধারণা দেওয়া হয়েছিল। যেমন, একজন অভাবী বৃদ্ধা, সে বাড়ি বাড়ি কাজ খুজতে যেতো, কাজ না পেলে ভিক্ষা বৃত্তি ছাড়া তাঁর আর গতি ছিল না । তাঁর কাজ খোঁজার একটা পদ্ধতি ছিল । সে বাহির থেকেই হাক ছাড়ত, ‘আম্মা! কাম-কাইজ আছে নি কোন? ভিত্রে আমু’? সাথে সাথে ওই বাড়িতে হৈচৈ পরে যেত। গৃহবধু চমকে উঠে বলতেন, না না ভিতরে আহনের কাম নাই, ওহানেই থাকো, চাইল পাঠাইতাছি’। বাহ্! কি আরাম, একবার হাক দিলেই হলো, স্বসম্মানে চাল, ডাল সহজেই তার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। গৃহস্থালী যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, এই বৃদ্ধা এলেই সব কাজ ফেলে রেখে কি ভাবে তাকে ভিক্ষা দিয়ে বিদায় করবেন সে চিন্তায়ই তারা সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকতো। আমি ভাবতাম এই বৃদ্ধা হচ্ছে একমাত্র ভিখারী যার সন্মান আছে, সে ভিখারী হতে পারে কিন্তু সম্মানিতা। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হতো এই বৃদ্ধাকে গৃহবধূগণ কেন এমন সন্মান করেন? অথচ অন্যান্য ভিখারী আসলে তাদের কিছুই দেয়া হয় না। শুধু মাফ করতে বলা হয় । এক ভিখারী তো বলেই বসলো, ‘হগলেই যদি মাফ করতে কয়, তয় আমরা খামু কি’? উত্তর আসে, ‘এখন বিরক্ত কইরো না অহন কামের সময়’। কি বৈষম্য! একজনকে না চাইতেই দেয়া হচ্ছে আরেকজন কিছুই পাচ্ছে না । ওই বৃদ্ধা যখন নানীর বাড়িতে হাক ছাড়ত আমি দৌড়ে বাহিরে যেতাম তাকে দেখার জন্য। আমাকে দেখেই ফোকলা দাঁতে অমায়িক মায়াময় একটা হাসি দিত। বলতো, ‘বাজান বালা আছেন নি? আম্মায় কি কাইজ কাম দিব? না চাইল (চাউল) দিব’? আমি ওর কথা শুনে দৌড়ে আবার বাড়ির ভিতরে চলে যেতাম। আমি বাড়ির কাজের মেয়েকে জজ্ঞেস করেছিলাম, কেন ওই মহিলাকে ভিতরে আসতে দেয়া হয় না? সে আসলেই কেন দৌড়ে গিয়ে তাকে চাল দিয়ে আসে? সে বলেছিল, ‘আল্লাহ! অ কতা আর কি কমু, ওই বুড়ির নজর খারাপ। মনে করেন কোন গাছের দিকে একবার যদি চায়া দেহে তাইলেই কাম সারা। ওই গাছ আর বাঁচনের উপায় নাই। মরবই মরব’। এইবার বুঝলাম কেন তাকে ভেতরে আসতে দেয়া হয় না। অতি যত্নের আম, জাম, লাউ-কুমড়ার গাছ, কে মারতে চায়! কি দরকার বুড়িকে বাড়ির ভেতরে এনে গাছে নজর লাগানো? তার চেয়ে যত তাড়াতাড়ি বিদায় করা যায় ততই মঙ্গল। তখন শিশু বয়সে বিশ্বাস করেছিলাম। কারন বয়সটাই অমন, যে যা বলত তাই বিশ্বাস হতো, তখন মনে হতো যে এই রটনা সুন্দর ঘটনা সাজিয়ে বলছে সে খুবই জ্ঞানী। এখন চিন্তা করি, ওই বৃদ্ধা রাস্তা চলতে চলতে কত গাছের দিকেই তো তাকিয়েছিলো, সে গাছ গুলোর কি মৃত্যু হয়েছিলো? মনে হয় না, তাহলে সারা গ্রাম গাছশূন্য হয়ে যেত! হয়তো কোন কোন বাড়ির গাছ ব্যাকটেরিয়া অথবা ফাঙ্গাস জনিত কারনে মারা গেছে, আর তার দায় গিয়ে পড়েছে ওই গো বেচারি অশীতিপর বৃদ্ধার উপর।
নির্দোষ মানুষের নামে অনেক মিথ্যা রটনা শোনার মধ্যে দিয়ে আমার শৈশব কেটেছে। গ্রামের আরেকজন নিরীহ লোকের কথা বলি, লোকটি ছিল পাগল টাইপ, গায়ে গরম কালেও শীতবস্ত্র পড়তেন ওই পাগল। শ্রুতি ছিল তার দিকে তাকানো যাবে না। সে যদি আমাদের দিকে তাকায়, তাহলে আমাদের নাড়িতে প্যাচ লেগে যাবে আর আমাদের মৃত্যু হবে। তাই ওই পাগল যদি কখনো সমানে পড়তো তাহলেই সর্বনাশ। আমি চোখ বন্ধ করে টিনের বেড়ার দিকে মুখ করে থাকতাম, তার নজর এড়াতে। এই ধারণা নিয়ে অনেকদিন কেটে গেলো। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ি তখন। একদিন দূর থেকে দেখলাম ওই পাগল একটা লোকের সাথে কথা বলছে। সর্বনাশ ! লোকটি করে কি? ওর কি নাড়িতে প্যাচ লাগার ভয় নাই না কি! তারপর কিছু দিন ওই লোকের দেখা নেই, ভাবলাম নাড়িতে প্যাঁচ লেগে মনে হয় ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। সপ্তাহ খানেক পর দেখলাম ওই লোকের নাড়িতে তো প্যাঁচ লাগেই নাই সে মনের সুখে বিড়ি টানছে। আমি তখন বাল্যকাল ও কৈশোর পার করে তারুণ্যে পা রেখেছি। তরুণদের কৌতূহল অন্যরকম। তাই একদিন সাহস করে ওই পাগলের মুখোমুখী হলাম। আমাকে দেখে পাগলটি হেসে বললো, ‘মিয়া ভাই আমার সামনে আসতে আফনের ডর করে না’? মনে মনে ডর থাকলেও উপরে সাহস নিয়ে বললাম, ‘নাহ! কেন ডর করবে’? পাগল হেসে বললো, ‘আফনি আমারে দ্যাখলেই চোক বুইনজ্যা অন্যদিকে চায়া থাকতেন, পাছে আবার আফনের নাড়িতে ফ্যাচ লাগে’! আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি যে চোখ বুঝে থাকতাম তা সে জানতো। তাই একটু অসস্তি লাগছিলো। সে বললো, ‘আফনে বড় গরের সন্তান আল্লাহ আফনারে বালা রাহুক, হগগলে আমার নামে মিছা রটনা করছে, চিন্তা কইরেন না আফনার কোনো ক্ষেতি ওইবো না’। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম যে লোক এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে সে তো পাগল হতে পারে না। আজ অব্দি আমার নাড়িতে কোনো প্যাঁচ লাগে নি। তবে নাড়িতে প্যাঁচ না লাগলেও, জীবন চলার পথে অনেক প্যাঁচ। সেই প্যাঁচ খুলতে খুলতেই পার করলাম অনেক বছর। আর সে প্যাঁচের দায় অবশ্যই ওই কথিত পাগলের না।
বাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ৩১ আগস্ট ২০২০/এমএম





