Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ব্যর্থ রাজ্যটির ঠিক পেছনে একটা ছোট নদী বয়ে গেছে। ওটা ছিল স্বচ্ছ মনোরম জলের ধারা, বহু মাছ ছিল নদীটাতে। অনেক আগাছাও জন্মেছিল, মাছেরা সেসব খেত। রাজ্যটা ব্যর্থ হল কি হল না তা নিয়ে অবশ্য মাছেদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

ওটা রাজ্য কি প্রজাতন্ত্র তাতেও কোনো ইতরবিশেষ ছিল না ওদের কাছে। ওরা তো ভোট দেয় না, ট্যাক্সও দেয় না। ওরা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, আমাদের কাছে কোনোই তফাৎ নেই।

আমি জলের ধারায় পা ধুই। বরফশীতল জলে সামান্য ভিজেই পা দুটো লাল হয়ে ওঠে। মিনারের মাথায় দুই রঙের পতাকাটা উড়ছিল তখন, বাতাসে কাঁপছিল। নদীর পাড় বেয়ে যাওয়া সবাই দেখত পতাকাটা, আর বলত, ‘এইযে, দেখুন। ব্যর্থ রাজ্যের পতাকা ওটা।’

কিউ আর আমি বন্ধু- অথবা আমার বলা উচিত, কলেজে বন্ধু ছিলাম আমরা। প্রায় দশ বছরেরও বেশি আগে বন্ধুরা যা করে আমরা তা-ই করতাম। সে জন্যই আমি এখানে অতীতকাল ব্যবহার করলাম। যা-ই হোক, আমরা বন্ধু ছিলাম।

যখনই কাউকে ব্যক্তি কিউ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে কিছু বলতে হয়- আমি সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করি। কোনোকিছু ব্যাখ্যা করায় কখনোই ভালো ছিলাম না আমি, তবু সেটা ধরে নিয়েই কারও কাছে কিউকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা ছিল একটা বিশেষ ধরনের চ্যালেঞ্জ। আর যখন চেষ্টা করি তখন একটা গভীর হতাশ অনুভবের কাছে পরাস্ত হই আমি।

ব্যাপারটা যতখানি সম্ভব সোজা করে বলি।

কিউ এবং আমি সমবয়সী, কিন্তু সে প্রায় পাঁচশ সত্তর গুণ বেশি সুপুরুষ। ওর একটা চমৎকার ব্যক্তিত্বও আছে। সে কখনোই জবরদস্ত কিংবা দাম্ভিক নয়, কেউ যদি দুর্ঘটনাবশত ওর জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে কখনোই রাগ করে না ও। বলবে ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি নিজেও একই কাজ করেছি।’ তবে আসলে আমি কখনই শুনিনি যে সে কারও কোনো ক্ষতি করেছে।

ওকে ভালোভাবে মানুষ করাও হয়েছিল। ওর বাবা ছিলেন একজন চিকিৎসক, শিকোকু দ্বীপে যার একটা ক্লিনিক ছিল, মানে কিউকে কখনোই হাত খরচের টাকা চাইতে হতো না। তার মানে এই নয় যে টাকা-পয়সা অপচয় করত ও। পোশাকে ছিল কেতাদুরস্ত এবং আকর্ষণীয় ক্রীড়াবিদ, টেনিস খেলত হাইস্কুলে ইন্টারস্কলাস্টিক টুর্নামেন্টে।

সাঁতার পছন্দ করত বলে সপ্তাহে অন্তত দু’বার সুইমিংপুলে যেত ও। রাজনৈতিকভাবে ও ছিল মধ্যপন্থী উদার মতাবলম্বী। পরীক্ষার ফলাফলে সেরা না হলেও অন্ততপক্ষে খারাপ ছিল না। পরীক্ষার জন্য প্রায় পড়তই না ও কখনও, কিন্ত কখনও কোনো কোর্সে ফেলও করেনি। তবে ক্লাস লেকচারগুলো শুনত সত্যিকার মনোযোগ দিয়ে।

পিয়ানোতে বিস্ময়কর রকমের মেধাবী ছিল ও, ওর কাছে ছিল বিল ইভান্স আর মোজার্টের প্রচুর রেকর্ড। ওর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ফরাসিদের প্রতিই ঝোঁক ছিল বেশি- বালজাক ও মপাঁসা। কখনও সে কেনজাবুরো ওয়ে কিংবা অন্য লেখকদের উপন্যাসও পড়ত। ওর সমালোচনাও সবসময় ছিল সঠিক মানের।

মেয়েদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় ছিল ও। তবে ‘যাকে পাওয়া যায় তার সাথে’ ধরনের লোক সে ছিল না। ওর একটা নির্দিষ্ট মেয়ে বন্ধু ছিল, উঁচুদরের মহিলা কলেজের এক সুন্দরী সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। প্রতি রোববার ওরা দু’জনে মিলে বাইরে যেত।যা-ই হোক, কলেজে এ কিউকেই চিনতাম আমি। সংক্ষেপে বললে ওর চরিত্রের মধ্যে কোনো খুঁত ছিল না।

তখন আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টে থাকত কিউ। লবণ কিংবা সালাদ ড্রেসিং ধার দেয়া-নেয়ার মধ্যে যা হয়, আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম, খুব শিঘ্রই আমরা গান শোনা কিংবা বিয়ার খাওয়ার জন্য সব সময় কেউ কারও না কারও ঘরে থাকতাম। একবার আমি এবং আমার মেয়ে বন্ধু কিউ আর ওর মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে কামাকুরার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একসঙ্গে খুব স্বচ্ছন্দ থাকতাম আমরা। তারপর ওপরের ক্লাসে সামারের ছুটির সময় বাইরে চলে যাই আমি, আর সেখানেই শেষ।

পরেরবার কিউকে যখন দেখি, প্রায় একদশক পেরিয়ে গেছে। আকাসাকা জেলার এক ঘ্যাম হোটেলের পুলের পাশে বসে একটা বই পড়ছিলাম আমি। আমার পরের ডক চেয়ারে বসে ছিল কিউ, ওর পাশে বিকিনি পরা লম্বা পায়ের এক সুন্দরী নারী।

আমি ঠিক জানতাম ওটা কিউ। সব সময়ের মতোই সুপুরুষ দেখাচ্ছিল ওকে, তবে এখন ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে ওর চেহারায় এক ধরনের আভিজাত্য এসেছে, যা আগে ছিল না। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া তরুণী-যুবতীরা একঝলক তাকিয়ে দেখছিল ওকে।

আমি যে ঠিক ওর পাশে বসা সেটা লক্ষ করেনি ও। দেখতে খুব সাদামাটা মানুষ আমি, তাছাড়া চোখে ছিল সানগ্লাস। বুঝতে পারছিলাম না আগবাড়িয়ে ওর সঙ্গে কথা বলব কি না, শেষে ঠিক করলাম বলব না। মহিলাটির সঙ্গে খুব গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিল বলে ওদের কথার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটাতে ইতস্তত করছিলাম আমি।

তা ছাড়া আমাদের মধ্যে বলার মতো অনেক বিষয়ও ছিল না। ‘মনে আছে তোমাকে লবণ ধার দিয়েছিলাম?’ ‘আরে হ্যাঁ, ঠিক, আমি এক বোতল সালাদ ড্রেসিং নিয়েছিলাম তোমার কাছ থেকে।’ তারপর আমাদের প্রসঙ্গ দ্রুত ফুরিয়ে যেত। তাই আমি মুখ বন্ধ রেখে বইয়ের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখি।

তারপরও কিউ আর তার সুন্দরী সঙ্গিনী নিজেদের মধ্যে কী কথা বলছে তা শোনার লোভ সামলাতে পারি না আমি। বিষয়টা ছিল বেশ জটিল। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বইটা পড়ার চেষ্টা করতে করতে ওদের কথা শুনতে থাকি।

মহিলা বলে, ‘হতেই পারে না, তুমি ঠাট্টা করছ।’

কিউ বলে, ‘জানি জানি, কি বলতে চাইছ তুমি। তবে তোমাকে ওটা আমার মতো করেও দেখতে হবে। আমি চাই বলেই এটা করছি, তা নয়। ওপরের তলায় যারা থাকে তারাই কিন্তু আসল লোক। ওরা যা সিদ্ধান্ত দেয়, সেটাই কেবল বলছি তোমাকে। সুতরাং আমাকে ওভাবে দেখ না।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে,’ মহিলাটি বলে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিউ।

কল্পনার মাধ্যমে বেশ কিছু শূন্যস্থান পূরণ করে ওদের দীর্ঘ আলাপটার সারাংশ করা যায় এভাবে। মনে হচ্ছিল কিউ এখন কোনো একটা টিভি স্টেশন কিংবা এ রকম কোনো কিছুর ডিরেক্টর, আর মহিলাটি মোটামুটি বিখ্যাত কোনো শিল্পী বা অভিনেত্রী। তাকে কোনো একটা প্রজেক্ট থেকে চলে যেতে হচ্ছে কারণ কোনো একটা ঝামেলা বা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে ও, কিংবা এমনও হতে পারে যে স্রেফ তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে বলে।

তাকে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে কিউর ওপর, কারণ, এসব দৈনন্দিন কাজ দেখাশোনা করার জন্য সে-ই সরাসরি দায়িত্বশীল ব্যক্তি। বিনোদন শিল্প সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না আমি, তাই এটার সূক্ষ্ম জায়গাগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি না, তবে মনে হয় না খুব বেশি দূরে রয়েছি।

যতটুকু শুনলাম তা থেকে ধারণা করি যে কিউ খাঁটি বিশ্বস্ততা নিয়ে তার দায়িত্ব পালন করছিল।

কিউ বলে, ‘স্পন্সর ছাড়া আমরা চলতে পারব না। সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে না- এই ব্যবসা সম্পর্কে জান তুমি।’

‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে এ ব্যাপারে তোমার কোনো দায়িত্ব বা মতামত দেয়ার অধিকার নেই?’

‘না, আমি সেটা বলছি না। কিন্তু আমি যা করতে পারি সেটা সত্যিই সীমিত।’

ওদের কথাবার্তা আরেক দিকে মোচড় দিয়ে কানাগলিতে পৌঁছে যায়। মহিলা জানতে চায়, ওর জন্য কিউ ঠিক কতখানি নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। সে বলতে থাকে যে তার যা করা সম্ভব সবকিছুই করেছে সে, কিন্তু সেটা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই, তবে মহিলা সে কথা বিশ্বাস করে না।

আমিও ওকে বিশ্বাস করিনি। সে যতই অকপটভাবে বিষয়গুলো বোঝানোর চেষ্টা করছিল, কৃত্রিমতার ধোঁয়াশা ততই সবকিছুর ওপর এসে ঝুলে পড়ছিল। তবে সেটা কিউর দোষ নয়। অন্য কারোরও নয়। সে কারণে এই আলোচনার কোনো সমাধান বের হয়ে আসে না।

মনে হল মহিলাটি কিউকে আগে পছন্দই করত। ধারণা করতে পারি এই ব্যাপারটার উদ্ভব হওয়ার আগে পর্যন্ত ওদের দু’জনের বেশ ভালোই যাচ্ছিল। যার কারণে সম্ভবত মেয়েটির রাগ আরও বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যদিও ওকেই হার মানতে হয়।

সে বলে, ‘ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি। এখন আমাকে একটা কোক খাওয়াও, খাওয়াবে না?’

এটা শোনার পর কিউ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর ড্রিংক কাউন্টারের দিকে চলে যায়। মহিলা ওর সানগ্লাসটা পরে নিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতক্ষণ ধরে আমি বইটার একই লাইন কয়েকশবার পড়ে ফেলেছি।

কাগজের দুটো বড় কাপ নিয়ে কিউ দ্রুতই ফিরে আসে। মহিলার হাতে একটা তুলে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসার জন্য নিচু হয় ও। বলে, ‘এটা নিয়ে এত মন খারাপ করার কিছু নেই। যে কোনো দিন আপনি -’

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মহিলা ভর্তি কাপটা ওর গায়ে ছুড়ে মারে। ওটা সরাসরি ওর মুখে এসে লাগে, আর তিনভাগের একভাগ আমার গায়ে ছিটিয়ে পড়ে। একটি কথাও না বলে মহিলাটি উঠে দাঁড়ায়, তারপর বিকিনির পেছন দিকটায় একটা ছোট ঝাঁকি দিয়ে পেছনে না তাকিয়ে লম্বা পায়ে হেঁটে চলে যায়। আমি আর কিউ পনেরো সেকেন্ডেরও বেশি সময় স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকি। কাছে থাকা লোকজন বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কিউই প্রথমে সম্বিত ফিরে পায়, তারপর টাওয়েলটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, ‘দুঃখিত।’

আমি বলি, ‘না, ঠিক আছে। গোসল করে নেব আমি।’

কিছুটা বিরক্ত হয়ে টাওয়েলটা ফিরিয়ে নেয় ও, তারপর ওটা দিয়ে নিজের গা মুছতে থাকে।

ও বলে, ‘আমাকে অন্তত বইটার দাম দিতে দিন।’ এটা ঠিক যে আমার বইটা পুরো ভিজে গিয়েছিল। তবে শস্তা এক পেপারব্যাক ছিল ওটা, আর সে রকম মজারও ছিল না। যে ওটার ওপর কোক ছুড়ে দিয়ে আমার পড়ায় বাধা দিল, সে বরং উপকারই করেছে আমার। এ কথা শুনে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবসময়ের মতো ওর মুখে ছিল একই রকম চমৎকার হাসি।এবার উঠে দাঁড়িয়ে আরও একবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে কিউ চলে যায়। আমি কে সেটা বুঝতে পারেনি ও।

ঠিক করি এই গল্পটার নাম দেবো ‘ব্যর্থ রাজ্য’, কারণ সেদিন সান্ধ্য কাগজে আফ্রিকান এক ব্যর্থ রাজ্য নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। ওটায় বলা হয়, ‘একটা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়া দেখার চেয়ে একটা সমৃদ্ধ রাজ্য ধীরে ধীরে বিলীন হতে দেখা অনেক বেশি দুঃখজনক।

জাতক কিংবা পঞ্চতন্ত্রের গল্প, ঈশপের নীতিকথা কিংবা বীরবলের গল্পসমৃদ্ধ অতি ছোটগল্প বলে কথা সাহিত্যের যে একটা শীর্ণ শাখা আছে, তার ধারাবাহিকতায় নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিন আয়োজন করেছিল গ্রীষ্মকালীন অনলাইন ফ্ল্যাশ ফিকশন সিরিজ। সেই আয়োজনে ‘কিংডম দ্যাট ফেইলড’ নামে হারুকি মুরাকামির সর্বশেষ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে ১৩ আগস্ট, ২০২০ সংখ্যায়। মূল জাপানি থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জে রুবিন।

হারুকি মুরাকামির (জন্ম : ১৯৪৯) বাবা ছিলেন সাহিত্যের শিক্ষক। তার বাবা-মা দু’জনই চেষ্টা করেছিলেন জাপানি সাহিত্য সম্পর্কে তাকে আগ্রহী করে তুলতে। টোকিওর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে পাস করে বের হওয়ার পরপরই একটা কফি শপ ও জ্যাজবার খোলেন তিনি। এ সময়ই লেখালেখির জগতে প্রবেশ ঘটে।

প্রথম উপন্যাস হিয়ার দ্য উইন্ড সিং (১৯৭৯) লাভ করেছিল গুঞ্জো সাহিত্য সাময়িকী পুরস্কার। আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার আছে তার ঝুলিতে। ২০১৮ সালে বিকল্প নোবেলে তার নাম হ্রস্বতালিকায় উঠে এলে তিনি নিজ নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, কারণ সংবাদ মাধ্যমের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে লেখার কাজে মনোনিবেশ করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ২৬ আগস্ট ২০২০/এমএম


Array