Menu

বায়াজিদ গালিব :: প্রথম যেদিন শুনলাম বইয়ের সাথে বউয়ের মিল আছে সেদিন একটু অবাকই হয়েছিলাম। অনেক আগের স্মৃতি থেকে লিখছি। আমার কৈশোর কেটেছে সিদ্ধেশ্বরীতে। সে সময় সিদ্ধেশ্বরীতে এত ঘন বসতি ছিল না। প্রায় সবার বাড়ির সামনে বা পেছনে খেলার জায়গা ছিলো। সিদ্ধেশ্বরী বালক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ তো ছিলই। আমরা সবাই মিলে ফুটবল, ক্রিকেট, আর ব্যাডমিন্টন খেলতাম, মৌসুম অনুযায়ী। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার মজাই আলাদা। সেই পাড়ার এক বড় ভাই আমাদের সাথে খেলাধুলা করতেন। উনি বেশ ভালো ক্রিকেট খেলতেন। এবং প্রথম বিভাগেই খেলতেন। তার ব্যাটিং স্টাইলে আমরা খুবই মুগ্ধ হতাম। আর পাড়ার মেয়েরা মুগ্ধ হবে এ আর এমন কি? মেয়ে ভক্তের জ্বালায় তাঁর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। “আশেপাশে কত লোক কার সাথে মেলাই চোখ” এ উক্তিটি তখন তার জন্য যথার্থ ছিল। সে চোখ মেলাতে গিয়ে বড় সমস্যা হলো ক্রিকেট বল থেকে চোখ সরে গেলো আর ঠকাস করে উইকেট পতন। তিনি হয়তো একবার ভাবলেন, আমার চোখ তো দুইটা, তাহলে একটা বলের দিকে রাখি আরেকটা ওই দিকে। নাহ! এ পদ্ধতিতেও কোনো কাজ হলো না। এভাবে হবে না তাই একজনের দিকেই চোখ স্থির করলেন। তারপর থেকেই ধপাস ধপাস করে তাঁর উইকেট পরতে লাগলো। কোনো খেলায় রান করতে পারছেন না। প্রেমে পরেছেন। তাই মন অস্থির। অন্ধ প্রেমে চোখও যেন অন্ধ হয়ে গেলো। প্রেমে পরা থেকে তো উঠতেই পারছেন না, আর রানের অংকও দশের উপর উঠাতেই পারছেন না। কি মুশকিল! ক্লাবের লোকজন খুবই বিরক্ত।
ব্যাপারটা নিয়ে আমরাও চিন্তায় পরে গেলাম। একদিন সবাই মিলে তাকে নিয়ে বসলাম। তার বর্ণনা অনুযায়ী তিনি যে মেয়ের প্রেমে পড়েছেন, সে মেয়ে তা জানে না তাই তার এ অস্থিরতা। এ যে দেখছি-জেনেশুনে বিষ পান! আমরা অনেক চেষ্টা করে মেয়েটির সাথে তার দেখা করিয়ে দিলাম, তাদের ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পেলো, তিনি আবার রান সংগ্রহ শুরু করলেন। ক্লাবের কর্মকর্তারাও খুশী, সাথে আমরাও। খেলার মৌসুম শেষে একদিন ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়ে গেলো। পরের বছর অন্য ক্লাবে আরো চড়ামূল্যে চুক্তিবদ্ধ হলেন। কয়েকটা ম্যাচ বেশ ভালোই খেললেন। ঘরে নতুন বউ। প্রেম সার্থক, বিয়ে সার্থক। কিন্তু এ কি তার আবার ঠকাস ঠকাস উইকেট পতন শুরু হলো। ব্যাপার কি? আমরা আবার তাকে নিয়ে বসলাম। তিনি বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার আপনার কি হলো আবার? অন্য কারো প্রেমে পরলেন না কি? উনি বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, তোমরা কি বই আর বউ এ দুটির মিল ও অমিল জানো? আমরা আকাশ থেকে পড়লাম, বলে কি! মাথা দেখি একদম আউলা। উনি বললেন, তোমরা যা ভাবছো তা না। আমি বিয়ের পর বউ এবং বইয়ের মিল ও অমিল দুটোই খুঁজে পেয়েছি। মিল হচ্ছে দুটোই পড়তে হয়, অমিল হচ্ছে একটির পাতা পড়তে হয় অন্যটির মন পড়তে হয়। আমি বইয়ের পাতা পড়তে পারলেও বউয়ের মন পড়তে ব্যর্থ।
বলে কি? তাহলে দস্যু বনহুরের কি অবস্থা হয়েছিল। একজন সাধারণ পুরুষ দুই স্ত্রীর প্রয়োজন নেই, কিন্তু দস্যু বনহুর তো আর সাধারণ পুরুষ না তাই তাঁর দু’জন স্ত্রী ছিলো একজন জঙ্গলে অন্যজন শহরে, শহুরে স্ত্রীর নাম মনিরা ও অপরজনের নাম নূরী। নূরী হচ্ছে বইয়ের মত যার মন পড়তে হয় না শুধু পাতা পড়লেই হয়ে যায়। আর মনিরা শহরে সাংসারিক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত, সুখ দুঃখ সমস্যায় নিয়েই ব্যস্ত, দস্যু বনহুরকে অবশ্যই শহুরে স্ত্রীর মন পড়তে হতো। তবে যাই হোক কিশোর বয়সে দস্যু বনহুর খুব ভালো লাগতো। মনে হতো কি সুখী জীবন। দুই প্রান্তে দুই স্ত্রীর সেবা। ওই বয়সে দস্যু বনহুর হওয়ার ভাবনা মোটেও অমূলক ছিল না।
বই পড়ার চেয়ে বই লেখার বাসনা অনেকের বেশী। বই পড়ুক আর না পড়ুক বই এক খানা প্রকাশ করতেই হবে। অনেক আগের কথা, আমার অফিসের এক পিয়নের ছড়া জাতীয় কিছু লিখে বলে আমাকে জানালো। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, বাহ্ বেশ তো! তা তুমি কি ধরণের, মানে কি নিয়ে লিখ? তার উত্তর, ‘বিভিন্ন ঋতু, ও বিষয় নিয়ে’। আমি ওকে বললাম, ‘ঠিক আছে আমাকে দেখিয়ো তোমার ছড়া বা কবিতা’। আমি কবিতা বিশারদ না হলেও, কবিতার বিশেষজ্ঞ মানে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। আমি বেশ আনন্দিত হলাম, ওকে সমীহের চোখে দেখতে লাগলাম। সে কবিতার বই ছাপাতে চায় কিন্তু তার পরিচিত কেউ না থাকায় পারছে না। একবার অনেক কষ্টে এক প্রকাশকের কাছে গিয়েছিলো। তার কবিতা দেখে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। এবং বলেছিলেন তার কাছে যেন ভবিষ্যতে দেখা করার চেষ্টা না করে। কি অপমান! আমি ভাবলাম এমন তো হতেই পারে, অনেক নামি দামি কবি লেখকের বই প্রাথমিক অবস্থায় প্রকাশক ছাপে নাই। পরবর্তীতে দেখা গেছে কোন এক অজ্ঞাত প্রকাশক সে বই ছেপে নিজের ব্যবসাও করেছে এবং লেখকও বিখ্যাত হয়ে গেছেন। আমি বললাম, ‘তুমি নিয়ে এসো আমার পরিচিত প্রকাশক আছেন, চেষ্টা করে দেখতে পারি’। বেশ কিছুদিন কেটে গেলো, একদিন হঠাৎ আমার টেবিলে একটা খাতা। খাতার উপরে লেখা “বিস্ময়”। বুঝলাম পিয়ন কবিতার খাতা আমার টেবিলে রেখে লজ্জায় পালিয়েছে। বাহ্! সুন্দর নাম তো “বিস্ময়’। ভাবলাম পরে ওর কবিতা পড়ে দেখবো, এখন ব্যস্ত, তাই খাতাটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলাম। এবং আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। সব সময় দেখি ও আমার সামনে ঘোরাঘুরি করে আর করুন চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে। অফিসের কাজের চাপে বেমালুম ওর কবিতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। একদিন দুপুরে খাবার বিরতিতে পিয়নকে ডেকে ওর কবিতার খাতা খুললাম। প্রথম কবিতার দু’লাইন পরে ওর “বিস্ময়’ কবিতায় আমি বিস্মিত হলাম।
আমি তার দু’একটি কবিতা বা ছড়া আপনাদের আমার স্মৃতি থেকে সামনে উপস্থাপন করছি।
সৃষ্টির বিস্ময়
আলেয়ার আলো তুমি দেখিয়েছো কভু
এমন বিস্ময় সৃজিলেন প্রভু।

প্রকৃতির বিস্ময়
ঘাস খায় গরু, কাঁধে তার চিল
বিল ভরা মাছ, করে কিলবিল।…….. (ব্র্যাকেটে লেখা ছোটদের ছড়া)

আমি বললাম, তুমি লেখাপড়া কতদূর করেছো?
উত্তর, ম্যাট্রিক দেওয়া হয় নাই।
কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা কে?
উত্তর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের কবিতা কি ভাবে তোমাকে উৎসাহ দিয়েছে।
স্যার, আমিও আন্ডার ম্যাট্রিক সেও আন্ডার ম্যাট্রিক।
আমার বিস্ময় আর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। বললাম, তুমি আমার সামনে থেকে যাও, আর তোমার খাতা নিয়ে যাও।
বই পড়ার সুফল অনেক। অনেক আগের কথা। তখন আজকালের মত প্রাইভেট হাসপাতাল তেমন গড়ে উঠেনি। ভালো হাসপাতাল বলতে হলিক্রস, সি.এম.এইচ., পিজি, বারডেম, সোহরাওয়ার্দী আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। বারডেম ও হলিক্রস ছাড়া অন্যান্য হাসপাতালের রক্ষনাবেক্ষন তেমন ভালো ছিল না। ফিনাইলের উটকো গন্ধে, হাসপাতালে বেশীক্ষন টেকা দায়ছিল। ফলে হাসপাতালে ঢুকলেই কেমন একটা বাজে গন্ধ লাগতো। সে সময়ে আমার এক বন্ধু অসুস্থ হলে তাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো, ছোট্ট একটা অপারেশনের জন্য। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপর খুব একটা সন্তুষ্ট না। কারণ ডাক্তারদের অতিরিক্ত গাম্ভীর্য। সে সময় রোগ সম্পর্কে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, আপনাকে বলে কি লাভ? আপনি বুঝবেন কিছু? যত্তসব ঝামেলা। যেন এখানে রুগী এসে তাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। যা হোক, আমি একদিন তার সাথে দেখা করতে গেলাম তার কেবিনে। দেখলাম সে তন্দ্রা নিমগ্ন। চোখে রিমলেস রিডিং গ্লাস, বুকের উপর লিও তলস্তয়ের “ওয়ার এন্ড পিস”। পাশের বেড সাইড টেবিলে উইলিয়াম হান্টারের ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলিম” সহ আরো কিছু ইংরেজি বই। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। এ বন্ধুটি মাস্টার্স পরীক্ষার পর বলেছিলো, আজ থেকে পড়া বন্ধ, বই তো অবশ্যই না, খবরের কাগজও না। আজ এই অসুস্থ শরীরে ধর্মীয় গ্রন্থ না, দোয়া কালাম না, সে ইংরেজি গল্পের বই পড়ছে! যতই অসুস্থ হোক আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। আমি ওকে ডাকলাম। চোখ মেলে আমাকে দেখেই ভুবন বিজয়ী একটা হাসি দিলো। আমি বললাম কি ব্যাপার বন্ধু সে বললো, কি ব্যাপার মানে? আমি বললাম, তোর বুকে লিও তলস্তয়! ও হেসে বললো, একটু ভঙ্গ ধরছি দোস্ত। এখানকার ডাক্তার-নার্সদের কাছ থেকে বেশ ভালো ব্যবহার পাচ্ছি। ওরা ঘরে ঢোকার আগেই আমার জিরো পাওয়ারের রিডিং গ্লাস পরে, পড়ার একটা ভাব ধরি, ব্যাস এতেই কাজ হয়ে যায়। আমাকে সমীহের দৃষ্টিতে দেখে, হেসে হেসে কথা বলে।
সে বললো, ‘বুঝলি দোস্ত, বউ সাথে থাকলে শুধু ছেলেরা হেসে হেসে কথা বলে কিন্তু বই সাথে থাকলে ছেলেমেয়ে সবাই হেসে হেসে কথা বলে’।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/১৯ আগস্ট ২০২০/এমএম


Array