বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা :: ছোটবেলায় ভূতের গল্প শোনেনি এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বিশেষ করে আমাদের সমসাময়িক যারা। আর এ গল্প শোনানোর জন্য খালা-ফুফু কিংবা নানী-দাদীগণ তো ছিলেনই। আর এই সব গল্পের দ্বারাই ছেলে বেলার অকুতোভয় মনকে ভীতু বানানো খুব সহজ পদ্ধতি ছিল মনে হয়। অবশ্য আমি ভুতের গল্প শুনতে খুব বেশি আগ্রহী ছিলাম।
জীবনে একবারই আমার ভুত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আল বেরুনী হলে থাকি। এ হলে এক ব্লক থেকে আরেক ব্লকে যাওয়ার সরাসরি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি ব্লকে আলাদা আলাদা সিঁড়ি। যেতে হয় গ্রাউন্ড ফ্লোর অথবা ছাদে উঠে। তখন আমাদের ক্লাস তেমন ভাবে শুরু হয় নাই। আমরা রাতের খাবার পর হলের ছাদে উঠে আড্ডা দেই। অনেক রাত পর্যন্ত সে আড্ডা চলে। আমাদের ব্লক থেকে আমার রুমমেট খোকন আর অন্যান্য ব্লক থেকে কিছু সহপাঠী ছাদে আড্ডা মারি। কোনো একদিন আমার ব্লক থেকে ছাদে গিয়েছি। সেদিন আমার রুমমেট ছিল না। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ভুতের গল্প করলাম। বেশ জমাট ভুতের গল্প। অনেকেই এক সাথে ছিলাম বলে ভয় মনে ঢোকে নি। কিন্তু যখন রুমে ফিরছি আমার ব্লকে আমি একা। সিঁড়ি অন্ধকার গা ছমছম করা ভয় নিয়ে ধীর পায়ে নামছি। আমার রুম তৃতীয় তলায়। চতুর্থ তলায় নেমে ভুত বাবাজিকে একঝলক দেখলাম। গলায় দড়ি দিয়ে ছাদের সাথে ঝুলছে জিহ্বা বের করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখ জ্বল জ্বল করছে। আমি একবার তাকিয়েই আমার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মুহূর্তে আমার পা থেকে যেন মাটি সরে গেলো। গা হিম হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। একবার ভাবলাম চিৎকার দেই। কি মনে করে চোখ খুলে আবার তাকালাম। দেখলাম ভুত বাবাজী তখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে এক ঝলক দেখার কারণে ভুত দেখেছিলাম। আসলে কেউ একজন একটা হ্যাঙ্গারে তার প্যান্ট শুকাতে দিয়েছে। জিনসের প্যান্টের বোতাম লাগানো আলগা কাপড় মনে হচ্ছে জিহ্বা আর ধাতব বোতামে আলো পড়ে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত চোখ। এ হচ্ছে আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ ভুত দেখা।
পরবর্তীতে আলবেরুনী হলের এক্সটেনশন জয়নুল আবেদিন হলে চলে আসলাম। এই হলটি একতলা। ছাদে উঠার ব্যবস্থা নেই। তিনটি ব্লক। প্রতিটি ব্লকের সামনে প্রবেশ পথে সিঁড়ি। সামনে কাঁটাতারের বেড়া। তারপর রাস্তা, রাস্তার পাশে লেইক। আমরা রাতে মাঝে মাঝে প্রবেশ পথের সিঁড়িতে বসে আড্ডা মারতাম। আমাদের হলের নাইট গার্ড গফুর মিয়া। সে রাতের ডিউটির পাশাপাশি তার পান, বিড়ি, সিগারেট ও চা বিক্রি করতো। টং ঘর ছিল হল সংলগ্ন। গফুর মিয়াকে কোনো কিছুর দাম দিলে খুব তাড়াতাড়িই টাকাটা নিত, কিন্তু ভাংতি ফেরত দেওয়ার সময় তার গতি হয়ে যেত মন্থর। খুচরা পয়সা ৭/৮ বার গুনতো যদি বেশি ফেরত দেয় সে ভয়ে। তারপর থেকে কাজে কর্মে যে বন্ধুর গতি ধীর তার নাম হয়ে যেত গফুর মিয়া। এ ভাবে আমাদের হলে বেশ কিছু গফুর মিয়ার সৃষ্টি হলো।
অনার্স পরীক্ষার সময় পড়ার চাপ অনেক। তাছাড়া আমাদের পড়া হচ্ছে সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার আগে পড়ুয়া ছাত্র হয়ে যাওয়া। তেমন এক রাতে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে আমাদের ব্লকের সিঁড়ির সামনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। শীত থাকায় গায়ে বিছানার সাদা চাঁদর। তখন রাত আনুমানিক ১২টা। সামনের লাইট পোস্টের বাল্ব ফিউজ হয়ে যাওয়াতে আমার বসার জায়গায় অপেক্ষাকৃত কম আলো। ওই সিঁড়ি থেকে গফুর মিয়ার দোকান দেখা যায়। আমি দেখলাম গফুর মিয়া দোকান বন্ধ করার জন্য দোকানের ঝাঁপ ফেলছে। সব শেষে অলস পায়ে আমাদের হলের রাস্তার দিকে আগাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার বাঁশিতে জোরে ফু দিচ্ছে। আর হাঁক ছাড়ছে ‘এই সাবধান’ ! সে আমার ব্লকের সামনে এসে, আমাকে দেখে চমকে উঠলো। আমার মুখে টর্চের আলো ফেলে বললো, ‘কে! কে! কে ওখানে’! হঠাৎ চোখে টর্চের লাইট পড়াতে বিরক্ত লাগছিলো। আমি বললাম, ‘এই মিয়া তোমার লাইট বন্ধ করো। আমি বসে আছি এখানে’। সে আলো বন্ধ করে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। আমি বললাম, ‘কি হয়েছে? ভয় পেলে কেন? এদিকে আসো’। সে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে গেলো, আমিও রুমে এসে ঘুম। পরদিন সকালের নাস্তার টেবিলে বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম। জানলাম, এ হলে জাকসুর জি.এস. মোজাম্মেলকে তার রুমে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তাকে না কি অনেকেই দেখেছে সাদা চাঁদর পড়ে ঘোরাফেরা করতে।
পরীক্ষা চলছে তাই কোনো ক্লাস নেই। দিবা নিদ্রার পর চোখ মেলে দেখি গফুর মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি উঠে বসলাম বললাম, ‘কি ব্যাপার গফুর মিয়া? কিছু বলবে’? সে বললো, ‘স্যার, কাইল রাইতে কি আফনে কি সিঁড়িতে বৈছিলেন’? আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘না তো’! লক্ষ্য করলাম গফুর মিয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে বললো, স্যার কিছু মনে করবেন না, ‘আফনে কি মেষ রাশির লোক’? আমি যে রাশিরই হই না কেন মজা করার জন্য বললাম, হ্যা! তো কি হয়েছে তাতে? সে বললো, ‘তেনারা মেষ রাশির লোকের উফর বর কইরা আসে’, আর তুলা রাশির জাতক হেইডা দেখতে পারে। আমি তো তুলারাশি। কি কপাল নিয়ে যে জন্মাইছিলাম। আমি বললাম, তেনারা কারা? সে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে বললো, ‘আমি মোজাম্মেল স্যারকে রাতে সাদা পোশাকে হলের চারপাশে গুইরা বেড়াইতে দেহি। তিনি কাইল রাইতে আফনের সূরাতে আফনের কণ্ঠে আইছিলেন আমার লগে কতা অইছে’। বলেই সে চলে গেলো। আমি বেশ মজা পেলাম। আমি ভাবলাম, তুলারাশির জাতক গফুর মিয়াকে তুলাধুনা করে প্রেতাত্মা আমার উপর ভর করেছে। আমি মেষ মানে ভেড়া, ভুত প্রেত ভেড়ার উপর ভর করবে না তো মানুষের উপর ভর করবে! ভুতের ভয় ডর বলে কিছু নেই নাকি!
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/১০ আগস্ট ২০২০/এমএম





