বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরী :: স্কুল জীবনে ইংরেজিতে এইম ইন লাইফ আর বাংলায় জীবনের লক্ষ্য নিয়ে রচনা লিখতেই হতো। নৌকা ভ্রমন, রেলগাড়ি ভ্রমন, নদির রচনা, গরুর রচনা, এইম ইন লাইফ এগুলি ছিল গতানুগতিক। প্রাথমিক বিদ্যালয় আমার জীবনে সবচেয়ে অভিশপ্ত মনে হয়। আমার মনে আমাদের যুগে সবারই ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের হাতে বেত, চেহারায় অভাবের ছাপ ও পোষাকে দৈন্য দশা। আমার ধারনা তাঁদের এই দারিদ্রের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতো আমাদের হাতের তালু আর পীঠে । ওনাদের মার খেতে খেতে আমরাও অভ্যস্থ হয়ে পরেছিলাম। যেদিন মার খেতাম না মনে হতো কি যেন নাই ।
অবশ্য শিক্ষদের দোষ দিয়েই বা কি লাভ? আসলে গোঁড়ায়ই ছিল গলদ। আগের দিনে স্কুলে ভর্তি করার সময় প্রায় সব বাবাই বলে দিতেন, ‘ মাস্টার সাব এই হচ্ছে আমার ছেলে, আপনাদের হাতে দিয়ে গেলাম, মানুষের মত মানুষ করতে হবে , প্রয়োজনে পিটিয়ে হাড্ডি মাংস আলাদা করে দিবেন। মাংস আমার হাড্ডি আপনার।
শিক্ষক তো মহা খুশী । জীবনের লক্ষ্য রচনায় সবসময় ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন দেখেছি বা শিক্ষকগন ওই স্বপ্নই দেখিয়েছেন। বলতেন যার জীবনের লক্ষ্য নাই সে কখনই বড় হতে পারে না। আমরাও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন দেখেছি। অনেক পরিকল্পনা করেছি কি ভাবে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়।
কিন্তু আমার মনে পরে না যে কখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চেয়েছে কেউ । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখা হয় নাই, আমার মনে হয় এর কারন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়য় সম্পর্কে আমাদেরর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের কোনই ধারনা ছিল না। ওই সময় আমরা বুঝতাম শিক্ষক মানেই হাতে বেত আর সেই বেতের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে আমাদের হাত ও পীঠ।
আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের বয়সের সাথে সাথে জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে এইম ইন লাইফে রূপান্তর হলো। আবার যে যা হতে চেয়েছে তাই হয়েছে এমন নজীরও আছে।
তেমন দুই জন সহপাঠীর কথা মনে পরে, যে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে পরবর্তীতে সফল হতে পেরেছিল। গ্রামের স্কুলের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই দরিদ্র। তাই তাঁদের এইম ইন লাইফের পরিধিও তেমন ছিল। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক প্রায়ই বলতেন এখন থেকেই তোমাদের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা উচিৎ। আমি কি হতে চেয়েছিলাম সে বিষয়ে পরে আসছি। তবে দুইজন সহপাঠী তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিল। একজন বলেছিল, ‘স্যার আমি আপনার মত শিক্ষক হতে চাই’। আরেকজন বলেছিল, ‘আমি আমার বাবার মুদির দোকানে কাজ করতে চাই’।
বলা মাত্রই শপাং শপাং পীঠে বেত। ওই বয়সে তাঁর মুদির দোকানদার হবার ইচ্ছেটা আমার কাছে মোটেই অযৌক্তিক মনে হয় নাই। বরং বাবার পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল বলেই সে দোকানদার হতে চেয়েছে। আমার ওই সহপাঠীর বাবার একটা মুদির দোকান ছিল। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল ওই একটা দোকান থেকে আরও অনেক দোকান করবে। কারন তাঁর বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। দিন দিন দোকানের উন্নতি তো দুরের কথা অবনতি ছিল লক্ষণীয়। আমার ওই সহপাঠীর উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ ছিল। তাঁর বাবার কষ্ট সে বুঝতে পেরেছিল।
তাই পঞ্চম শ্রেনির পর আর লেখাপড়া করতে পারে নাই। বাবার সাথে দোকানদারের কাজে লেগে গেলো। আমিও শহরে চলে এলাম লেখাপড়ার জন্য। প্রায় আট বছর পড় ওই গ্রামে গেলাম। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। শুনলাম আমার বন্ধু সহপাঠী সেলিম ব্যবসায়ে বেশ উন্নতি করেছে, সে একটা দোকান থেকে বড় বড় চারটা দোকান করতে সক্ষম হয়েছে। অনেকদিন পড় বন্ধুকে পেয়ে বেশ ভাল লাগলো। ওর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রন করলো।
ওর বাড়ি বেশ উন্নত মানের। গোলা ভরা ধান, গয়াল ভরা গরু, হাস মুরগি, পুকুর ভরা মাছ সবই আছে। আমি বললাম, ‘তোমার উন্নতিতে আমি খুবই খুশী, ‘তোমার এইম ইন লাইফ সার্থক। এই উন্নতির পেছনে তোমার চেষ্টা এবং সততাই মুল কারন’। বন্ধু আমার কথা শুনে হেসেই খুন। বললো, সততা কিনা জানিনা তবে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তবে আমি আমার পঞ্চম শ্রেনির শিক্ষা পুরাপুরি কাজে লাগিয়েছি এটা সঠিক।
আমি ঔৎসুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালে সে বললো, বন্ধু তোমার মনে আছে ? আমাদের অঙ্ক শিক্ষক মনরঞ্জন স্যার আমাদের লাভ ক্ষতির অঙ্ক শেখাতেন? আমি বললাম, হ্যা খুব মনে আছে। বন্ধুটি বললো, এক মন চাইলে এক সের কাঁকর মিশাইলে লাভ বা ক্ষতি হবে আর কয় সের দুধে কয় পোয়া পানি মিশাইলে লাভ বা ক্ষতি হবে, আমি মুদির দোকানের স্বপ্ন সামনে রেখে ওই অঙ্ক গুলিই খুব মনোযোগ দিয়ে শিখেছিলাম, আজ তাই কাজে লাগিয়েছি এবং সফল হয়েছি’।
আমার যে বন্ধুটি শিক্ষক হতে চেয়েছিলো সেও তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলো, এস এস সি’র পর স্কুলের শিক্ষকতার পরীক্ষা দিয়ে একই স্কুলে শিক্ষক হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মেয়ের জামাই হয়ে সুখে শান্তিতেই ছিল। আমার জানামতে আর কেউ তাদের জীবনের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নাই। এবার আমার ওই সময়ে আমার জীবনের লক্ষ্য কি ছিল তা বলি। আমার জীবনের লক্ষ্যের পরিবর্তন প্রতি ধাপেই বদলেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক রকম, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এক রকম আবার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যরকম।
আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল অন্যরকম। মেইল খানেক পায়ে হেটে স্কুলে যেতে হতো। স্কুলে যাবার পথে অনেক রকম দৃশ্য। কেউ মাছ মারছে, কেউ বা জমি চাষ করছে আবার কেউ কেউ মাঠে গরু ছাগল চড়াচ্ছে। এবং এই কাজগুলো করতে বাবাকে সাহায্য করছে আমাদের বয়সী ছেলেরা। ওদের স্কুলে যাবার সময় ছিল না। কিংবা স্কুলে যাবার খরচের যোগান ছিল না। আমার কাছে রাখাল বালকের কাজ খুবই সহজ মনে হতো।
গরু ছাগল মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে আর রাখাল বালক বসে আছে গাছের নিচে। ওদের দেখে খুব হিংসা হতো। কি সুন্দর স্বাধীন জীবন। স্কুলে যাবার তারা নেয় , লেখা পড়ার কোনো চিন্তা নেই। তাই আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম লেখাপড়া ছেড়ে রাখাল হবো। আমার এই পরিকল্পনা স্কুলের শিক্ষককে জানালাম।
এই কথা বলার পর আমি আশা করছিলাম আমার পীঠে সপাং সপাং কিছু পর্বে কিন্তু তা হলো না। ছুটির দিনে একদিন দেখি ওই শিক্ষক মহাশয় আমাদের এসে হাজির। আব্বার সাথে কথা বলছেন , সাথে চা নাশতা। আমার আব্বার সাথে তার কি কথা হয়েছিল জানি না। তবে আমার উদাসীনতা আর রাখাল হবার বিষয়টা অবশ্যই ছিল এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ ওই বছরই আমরা সিরাজগঞ্জ ছেড়ে পাবনা শহরে চলে গিয়েছিলাম। ওখানে আরো ভালো স্কুলে পড়ার জন্য। তাই আমার আর রাখাল হয় হলো না।
অধিকাংশ বাঙালি পরিবারের সন্তানদের ভবিষ্যতে কি হবে তা নির্ধারণ করেন পিতামাতা। ফলে, অতি অল্প সংখ্যক শিশু তার পিতামাতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। আমার বাবা কখনোই আমাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য চাপাচাপি করেন নি। এ ব্যাপারে আমি ছিলাম স্বাধীন এবং ভাগ্যবান। আর আমি কি হয়েছি আর কি হতে পারতাম এ নিয়ে আমার কোনই দুঃখ নেই।
আমি আমাদের বাসার কাজের ছেলেদের এই প্রশ্নটা করতাম, তুই বড় হলে কি হবি? একজনের উত্তরে খুব হেসেছিলাম। কাজের ছেলেটার নাম সালাম। আমাদের বাসায় ওর মা কাজ করতো, এবং তার প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব আমরা নিয়েছিলাম। ও খুবই হাসিখুসি একটা উচ্ছল প্রানবন্ত ছেলে।
আমি একদিন জিগ্যেস করলাম, ‘তুই বড় হলে কি হবি’? উত্তরে বললো, ‘আমি বড় হইলে মসজিদের মুয়াজ্জিন হমু’। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, দুনিয়াতে এত পেশা থাকতে তুই মোয়াজ্জিন কেন হতে চাস? ও বললো, মামা, হ্যাগরে কোন কাম নাই, খায় ঘুমায়, আজান দেয়, নামাজ পরে আর আজান দেয়, আবার মসজিদে থাকার জন্য ঘরও পায়, খুবই আরামের চাকুরী তাই আমি মোয়াজ্জিন হইতে চাই।
পরে শুনেছিলাম তাকে আর মোয়াজ্জিন হতে হয় নাই। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সরকারি অফিসের পিওন হয়েছে। তাই ছোট বেলায় যা হতে চায় তা হয় হয় না . সন্তানকে নিয়ে বাবা মা অনেক পরিকল্পনা করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের পরিকল্পনার পরী আকাশে উড়ে যায় আর পরে থাকে শুধুই কল্পনা।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৪ জুন ২০২০/এমএম





