বাংলানিউজ সিএ ডেস্ক :: রাজধানীর ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে চিরচেনা দৃশ্যপট। নেই মধ্যরাত পর্যন্ত সেই প্রাণচাঞ্চল্য, সেই কর্মব্যস্ততা। চারদিক সুনসান, স্তব্ধ, শোকার্ত। বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ, বার্ন ইউনিটে দগ্ধ মানুষের আহাজারি। টিভি স্ক্রিনে ভেসে বেড়াচ্ছে স্বজনহারাদের কান্না। ২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের প্রাণহানির পর পুরান ঢাকায় ৮০০ এর বেশি অবৈধ রাসায়নিক গুদাম এবং কারখানা চিহ্নিত করে সেগুলো কেরানীগঞ্জে বিসিক কেমিক্যাল পল্লীতে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
চকবাজারের চুড়িহাট্টা অগ্নিকান্ডের পর দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। নিমতলীর ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়। তার মধ্যে ছিল: জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানা উচ্ছেদ, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রভৃতি। কিন্তু ৯ বছর হলো এই কমিটির সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ অ্যাক্টিভিস্ট, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, যদি আমরা নিমতলীর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতাম। তাহলে এমন হতাহতের ঘটনা ঘটতো না। তারা বলছেন, কেবল দাহ্য বস্তু সরিয়ে নেওয়ায় মনোযোগী না হয়ে আগুনের সূত্রপাতের কারণের দিকেও মনোযোগ দেওয়া জরুরি। বাসা থেকে বের হতে না পারায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ পুড়ে মারা যায়। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো নিয়ে স্থানীয়রা যদি নিজেরা কাজ করে তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। তাই রাসায়নিক গুদাম অপসারণে কে এগিয়ে এলো কিংবা না এলো তা নিয়ে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির ভেতর ফেলে রাখার পরিবর্তে উদ্যোগ নিতে হবে স্থানীয় বাসিন্দাদেরকেই। মহল্লা কমিটিগুলোকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ বলেন, ভবন মালিকদের পাশাপাশি সাধারণ পর্যায়ে প্রতিটি মানুষকে যার যার নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। তা না হলে প্রশাসনের একার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব নয়। এলাকাগুলো সার্ভে করে ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থের কারখানা সরাতে হবে। সিটি করপোরেশনকে সরানোর দায়িত্ব নিতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, নিমতলীতে যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, চকবাজারেও ঠিক একই কারণে এত মানুষ মারা গেছে। নিমতলীর ঘটনাকে আমি হত্যাকান্ড বলব। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদনে যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন গত ৯ বছরেও হয়নি। এর পরিণতিতেই চকবাজারের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, এছাড়া এলাকার বান্দািদের সচেতন হতে হবে। নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে নিজেদেরকে উদ্যোগ নিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, চকবাজারে আগুন লেগে হতাহতের ঘটনাটি আমাদের নগর উন্নয়নের যে সার্বিক পরিস্থিতি তারই একটি দুঃখজনক ফল । পুরান ঢাকা বসবাসের জন্য খুবই সংকটজনক। আবাসিক এলাকার মধ্যে কলকারখানা, দোকানপাট, কেমিক্যাল ব্যবসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে দাহ্যপদার্থ থাকে। যার ফলে জায়গাটি অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আদালত থেকে হুকুম দেওয়া হয়েছে পুরান ঢাকা থেকে এসব প্রতিষ্ঠান সরানোর জন্য। এখন আইনের মাধ্যমে কঠোর হয়ে তাদের সরাতে হবে। এর জন্য সিটি করপোরেশন, রাজনীতিবিদ, রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প অধিদপ্তরকে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু মুখের কথায় হবে না।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইসফাক এলাহি চৌধুরী বলেছেন, সরকারের উচিত ছিলো নিমতলীর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাসায়নিক পদার্থ রাখার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে জোর দেয়া। কেউ যদি নীতিমালা না মেনে আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক গোডাউন তৈরি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দা এবং মহল্লা কমিটিগুলোকে নিজেদের মতো করে উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটির সদস্য রাজউক কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান জহির বলেন, রাজউক অনেকদিন ধরে কাজ করছে। তবে সবার আগে দরকার সচেতনতা।
পরিবেশ আন্দোলনকারী আবু নাসের খান বলেন, পুরোনো ঢাকায় যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকানের বেশিরভাগের নিবন্ধন বা লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্র নেই। ভোটব্যাংক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কর্তৃপক্ষ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় না বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ভাড়াটিয়া পরিষদ নামে একটি সংগঠন মানববন্ধনে বলেছে, চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হতাহতরা বাড়িওয়ালা ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের নিষ্ঠুরতার শিকার। সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক। সূত্র: ইত্তেফাক
বাংলানিউজসিএ/ইএন/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং