বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: আবহমান বাংলা কবিতার প্রবহমান ধারাকে আপন বৈভবে উজ্জ্বল ও সমুন্নত রাখার পাশাপাশি আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠা এবং কবিতার দুর্বোধ্যতা থেকে পাঠককে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে যে কজন কবি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন শামসুর রাহমান তাদের অন্যতম। ভিন্নতর কাব্যদর্শন ও আঙ্গিকচেতনায় অতু্যজ্জ্বল অভিনবত্বের স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি ঐতিহ্য-সচেতন এই কবির বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে অবদান অবিস্মরণীয়, অনন্য এবং তুলনারহিত। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এটি যে, শামসুর রাহমান তিরিশের কবিদের মনোবিশ্বমুখী মগ্নতাকে নিয়ে এসেছেন বাইরের জগতে, যেখানে বস্তুবিশ্বের প্রাধান্য প্রকট। ফলে এই জায়গাটিতে কবিসত্তা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অবারিত ধারায় প্রবহমান। এ ক্ষেত্রে কবির উচ্চারণ কেবল আত্মজৈবনিক আবেশে মুহ্যমান নয় কিংবা তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়েও স্বীকারোক্তিমূলক নয়। এ ক্ষেত্রে কবিমানস তীক্ষ্নদর্শী এবং কবিসত্তা আত্মবেদনায় দগ্ধ। সমকালস্পর্শী অপরাপর কবিদের মতো তিনি কেবল আত্মবেদনায় দগ্ধ হয়েই তৃপ্ত থাকেননি- জাতিসত্তা, জাতির অস্তিত্ব, নিজস্ব ভূখন্ডের জন্য লড়াই এবং তা রক্ষার জন্য সংগ্রাম ও অস্থিরতা কবিকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করত। এসবের সঞ্জীবনী ধারাকে বেগমান করার জন্যই তিনি সবকিছুকে দ্রবীভূত করেছেন নিজের মধ্যেই। কেবল তার পক্ষেই লেখা সম্ভব হয়েছে আসাদের শার্ট, সফেদ পাঞ্জাবি কিংবা একটি মোনাজাতের খসড়ার মতো কালোত্তীর্ণ কবিতা- যা আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়ে আসছে।
একজন সাহসী, সত্যনিষ্ঠ এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন কবি এভাবেই শৈল্পিক উচ্চারণে পালন করেন তার সামাজিক ও সংগ্রামী দায়িত্ব- যা পরে ঐতিহাসিক দায়িত্ব হিসেবে ব্যাপৃত ও প্রতিষ্ঠিত। যার কারণে তিনি এ দেশের প্রধান কবি হিসেবেও স্বীকৃত। কোনো কবির পক্ষে এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করা সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ বাংলা কবিতায় যাদের আজও অবাধ বিচরণ কিংবা যারা আজও সগৌরবে টিকে আছেন এবং ভবিষ্যতেও হয়তো পাঠকদ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবেন না তাদের অধিকাংশ কবিই নানা কারণে জীবদ্দশায় সমাদৃত হননি এবং বহুলাংশে উপেক্ষিতই হয়েছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে একথা স্পষ্ট যে, তিনি নিঃসন্দেহে একজন সৌভাগ্যবান কবি। তবে তার এই বিপুল জনপ্রিয়তা বা পাঠকপ্রিয়তা প্রাপ্তি এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। এ জন্য তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রচন্ড সহনশীল এবং সংগ্রামমুখর হয়ে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নানা বৈরী পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে বিরামহীনভাবে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। অসীম সাহসিকতা নিয়ে চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে কাব্যক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে হয়েছে। কারণ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে’ (১৯৬০) যখন প্রকাশিত হয় তখন বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করলেও উলিস্নখিত কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহে অনেকেই জীবনানন্দীয় ঢঙের গন্ধ খুঁজতে শুরু করে দেয়। তা সত্ত্বেও এই কাব্যে তার জীবনবোধের গভীরতা, রোমান্টিক চেতনা, জীবনবহির্মুখী বাস্তবতা এবং ব্যক্তির মনোজগতের স্বপ্নসৌন্দর্য প্রাণবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। কারণ শামসুর রাহমান তার প্রথম কাব্যগ্রন্থেই রেখেছিলেন এমন স্বাক্ষর যা প্রথমে কবিতাকে দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি যুগের মর্মবাণীকে সাদামাটাভাবে পাঠকের কাছে শিল্পসফলভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মানবজীবনের বাধাসংকুল ইতিবাচক ও নেতিবাচক ধারণাকে বিশ্বাসযোগ্য ও সহনশীল করে তুলেছেন। ফলে বাস্তবজীবন ও শিল্পের নিরাভরণ পরিচর্যায় যথেষ্ট পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তাই তিনি যন্ত্রণাবিদ্ধ সমকালীন জীবন-জিজ্ঞাসাকে ক্রমান্বয়ে রূপায়িত করতে পেরেছেন তার কবিতায়। ফলে জীবন এখানে আরও গভীরে প্রবেশ করায় বাস্তবতা হয়ে ওঠে কঠোর ও কঠিন।
তিরিশের আধুনিক ঐতিহ্যকে নিজসত্তায় ধারণ করে তারই ধারাবাহিকতায় তিনি আস্তে আস্তে হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট। ফলে জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক মানসপ্রবণতা ও মানসচেতনা তার কবিতায় উপজীব্য হয়ে ওঠে। বিষয় বৈচিত্র্যে এবং আঙ্গিক সচেতনতায় শামসুর রাহমান যে সফলতার পরিচয় দেন তাতে কবির মনোজগতের ভাঙন, আলোড়নসঞ্জাস বহুবর্ণিল রূপটিই ধীরে ধীরে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি একটি নেতিবাচক প্রণোদনাও তার ভেতর কাজ করতে থাকে। শামসুর রাহমান দীর্ঘকালের সাধনায় যে কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন, যে বিচিত্র শব্দ নিয়ে খেলা করেছেন- তাতে কবিতার শিল্প সুষমার সমস্ত সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে পৌঁছে যান এক বিশেষ আলোকবর্তিকায়। যা থেকে বেরিয়ে আসে অন্য এক শামসুর রাহমান। যা প্রকটিত হয়ে ডাল-পালা বিস্তার করে সদা ক্রিয়াশীল থাকে তারই কাব্যভুবনে যা একজন আধুনিক কবির বৈচিত্র্যময় জীবনসমীক্ষা।
তিনি বাস্তবতার নিরিখে অর্থাৎ স্বদেশ, স্বসমাজ, স্বাধিকার, বাঙালি জাতিসত্তা, বাঙালি জাতীয়তাসমৃদ্ধ বিষয়গুলোকে তার কবিতায় অত্যন্ত শিল্পসফলভাবে উপস্থাপন করেছেন। সে কারণে কল্পনা ও আবেগসঞ্চারী ভাবালুতার পরিবর্তে তার কবিতা হয়ে উঠেছে বাস্তবধর্মী এবং জীবনঘনিষ্ঠ। যেখানে আমরা জীবনের গভীরতর সত্যানুসন্ধানের ইঙ্গিত পাই। তিনি জীবনকে ছেনে-ছুঁয়ে দেখে তার স্বাদ গ্রহণ করেছেন বহুমাত্রিকভাবে- যা আধুনিক মনস্কতায় পরিপূর্ণ এবং উজ্জ্বল। যার বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক প্রতিফলন ঘটেছে তার বিভিন্ন কবিতায়। তার প্রথম দিককার কবিতায় ভাষা আন্দোলন উপজীব্য বিষয় হলেও পরবর্তীকালে গণজাগরণমূলক স্বদেশী চেতনানির্ভর কবিতা রচনার দিকে তিনি অধিক মাত্রায় মনোযোগী হন। ফলে স্বদেশপ্রেম, স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি মানবসত্তা বিশ্লেষণের দিকেও তিনি ঝুঁকে পড়েন। এর পাশাপাশি মানবপ্রেমটাও তার কবিতায় বেশ প্রাধান্য পায়। যার মধ্যে ক্রিয়াশীল রয়েছে সুগভীর বেদনাবোধ, আত্মবিদ্রোহসহ হৃদয়ের সূক্ষ্ণ আকুতি। এসব কবিতা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ এমনকি নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও আমাদের প্রবলভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, কবিতার মাধ্যমে রাজনীতির মর্মমূলে প্রথম আঘাত হানেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আর দ্বিতীয়বার বলিষ্ঠভাবে শামসুর রাহমান। কবিতার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক গণসচেতনতা সৃষ্টি করা যায় শামসুর রাহমান তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি দেশীয় প্রেক্ষাপটে দেশ, দেশের মানুষ এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, হতাশা-ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি সর্বোপরি মানুষের অন্তর্জগতের সঙ্গে বহির্জগতের তুলনামূলক চিত্রটি সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব এবং শ্রেয়বোধের প্রতি অধিকতর নিষ্ঠাবান থেকে তিনি যে প্রাণ প্রতিষ্ঠার ধ্বনি, সংগ্রামের ধ্বনি, প্রেম ও বিরহের ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন তা বাংলা কবিতায় বিরল। যার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে বিবেকের কণ্ঠস্বর। যা বিবেকতাড়িত হয়েও বিবেকসর্বস্ব। এর পাশাপাশি বাস্তবজীবন সম্পর্কিত ধারণাপুঞ্জ কবিকে এক অসাধারণ দীক্ষায় দীক্ষিত করেছে। একজন কবি যেহেতু সমাজেরই মানুষ সে কারণে সমাজের ভালো-মন্দ, হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা এমনকি সমাজ দেহের ভাঙন, পচন, অসাম্য মূল্যবোধের অবক্ষয়, নানাবিধ গোঁড়ামি ও কুসংস্কার, সমাজের অন্তর্গত মানুষের মর্মবেদনা ও হাহাকার তার কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ফলে রাজনীতি মনস্কতার পাশাপাশি তিনি একই সঙ্গে হয়ে উঠেছেন সমাজমনস্ক। এই সমাজমনস্কতা কবির স্বদেশী চেতনা ও স্বদেশপ্রেমের প্রধান দিক। সুতরাং শামসুর রাহমান যখন কবিতা লিখেছেন তখন তিনি কেবল শব্দের পর শব্দ সাজান না কিংবা কেবলই উপমা, উৎপ্রেক্ষা অথবা চিত্রকল্পের খোঁজে ঘুরে বেড়ান নি- এর পাশাপাশি কবিতার প্রকরণগত দিকটিকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। ফলে আমাদের মনোজগতে প্রতিমুহূর্তে যে ভাবনা ও জটিলতা- তা থেকে খুব সহজেই আমরা উত্তীর্ণ হতে পারি তার কবিতা পড়ে। কারণ আমরা যেমন সমাজবিচ্ছিন্ন নই তেমন বিচ্ছিন্ন নই রাজনীতি থেকেও। ফলে একজন সমাজমনস্ক ও রাজনীতিমনস্ক কবি উভয় উপলব্ধিতে হন ঋদ্ধ, উচ্চকিত ও মহীয়ান। যার সঙ্গে অনেকটা ঘেরাটোপের মতো পাঠককে সম্মোহনের মাধ্যমে জড়িয়ে ফেলেন। এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট প্রমাণ ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি।
ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানে শহীদ আসাদকে স্মরণ করে তিনি লিখেছিলেন: ‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুস আর লজ্জা সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক আসাদের শার্ট আমাদের প্রাণের পতাকা।’ ‘আসাদের শার্ট আমাদের প্রাণের পতাকা’ এ কথার মাধ্যমে কবি স্বাধীন ভূখন্ডের একটি নির্দিষ্ট পতাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন যার বাস্তবসম্মত রূপায়ণ আমরা পেয়েছি ‘৭১-এর রক্তক্ষয়ী, প্রাণক্ষয়ী, জীবনহারা স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে। এ ছাড়া গেরিলা, তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, ফেরারী ঊনসত্তর, এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় এবং শেষপর্যায়ে শহীদ নূর হোসেন স্মরণে লেখা- বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, সময়ের দাবি মিটিয়ে বিশেষ থেকে নির্বিশেষের দিকে যেন সদা ধাবমান। তার এই কবিতাগুলো আবহমান বাংলা কবিতার আদলকে পাল্টে দিয়ে কবিতার ক্ষেত্রে সর্বোপরি পাঠকের চেতনাজগতে একটা নতুন ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। যার কারণে কবিতাকেন্দ্রিক সমীক্ষায় শামসুর রাহমানের এই ধারার কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়, আবেদনসমৃদ্ধ ও হৃদয়গ্রাহী। কবিতার মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করেছেন। অন্তত এই প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিকোণ থেকে শামসুর রাহমান ব্যক্তি ও সমাজজীবন থেকে শুরু করে জীবনের বাধাসংকুল, ভয়-সংকুল প্রতিটি পদক্ষেপে, এমনকি রাজনৈতিক প্রভাববলয়েও আমাদের প্রধান প্রেরণার উৎস হয়ে দীপ্যমান থাকবেন।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৯ অক্টোবর ২০১৯/এমএম