Menu

বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরী থেকে :: ঘুষের রাজ্যে চলছে ঘুসাঘুসি। কে কত নিতে পারে। জীবন তো সীমিত কয়দিনই বা বাচঁবেন তাই যে যেমন পারো তেমন কমিয়ে নাও। একদিকে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। অন্যদিকে ঘুষের রাজ্যে পকেট পদ্যময়। ঘুষের উৎস সম্পর্কে একটি গল্প আছে। ইংরেজ শাসনামলে এক সাহেব ওই অঞ্চলের এক জমিদারের আমন্ত্রণে এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ওখানকার সব কৃষকগন, সাহেবের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফলমূল নিয়ে এলো। জমিদার ভাবল চাষারা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চায়। খাজনা মাফের একটা ফন্দী। এমন সময় সাহেবের নজর গেলো এক কাঁদি পাকা কলার উপর। তিনি বললেন হোয়াট আর দিজ ফর? জমিদার মওকা পেয়ে বলল, ‘দিজ আর অল ঘুষ মাই লর্ড’। সাহেব একটা পাকা কলা খেতে খেতে বললেন, ‘ভেরি টেস্টি, ইট ঘুষ, ইট ইজ গুড ফর হেলথ’। সেই থেকে নাকি বঙ্গদেশে ঘুষের প্রবর্তন। এবং ঘুষ খাওয়া। যারা ঘুষ খায়, তাদের কোন হুশ জ্ঞ্যান থাকে না। এবং এই ঘুষের কোনই সীমা নেই। হাঁসের মত, খেতেই থাকে কিন্তু খাওয়ার পরিমান এবং পরিনাম বোঝার কোন হিতাহিত জ্ঞ্যান থাকে না।

অনেক সময় অল্প ঘুষেও অনেকে খুবই সন্তুষ্ট থাকে। একবার কলকাতা থেকে ফেরার সময় দমদম বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েছি। আমি লাইনের সবচেয়ে পেছনে। সময় ছিল অনেক তাই তাড়া নেই। এমন সময় একজন ইমিগ্র্যাশনের লোক এসে আমার কাছে দাঁড়ালো। বললো, ‘দাদা কয়দিন ছিলেন কলকাতায়’ ? আমি বললাম, ‘এই তো দিন সাতেক’ ! তারপর প্রায় ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এনে বললো, ‘আপনার কাছে ভারতীয় মুদ্রা আছে’? দেশে ফেরার সময় সাধারণতঃ খুচরা ছাড়া তেমন কোনো টাকা পয়সা থাকে না। যতদূর মনে পরে আমার কাছে ৫ টাকা আর কিছু খুচরা ছিল। এতো কম পয়সা আছে ভেবে খুব ইতস্ততঃ করছিলাম।বললাম, ‘খুবই সামান্য আছে দাদা ৫ টাকা আর কিছু খুচরা’ আমার কথা শুনে বেশ খুশি হয়ে বললো, ‘ এ গুলো দিয়ে বাংলাদেশে কি করবেন দাদা আমাকে দিয়ে দিন চা নাস্তা খাবো’। আমি খুব খুশি মনেই দিয়ে দিলাম। কিছুক্ষন পর আবার দেখি ওই লোক আমার দিকে আসছে। এবার একটু বিরক্তই হলাম। আমার কাছে এসে আমাকে বললো, ‘দাদা আপনি আমার সাথে আসুন’। আমিও বিনা বাক্যব্যয়ে তার সাথে রওনা হলাম। আমি অবাক হলাম আমাকে নিয়ে সে আমার ইমিগ্রেশন ত্বরান্বিত করে দিলো। হাসি মুখে বললো, ‘দাদা ভালো থাকবেন’। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম, “৫ টাকার এতো জোর”!

ঘুষের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। কিশোরগঞ্জ থেকে বাবার কাজের কারনে পাবনা এসেছি। বীণা পানি হাই স্কুলের নাম পরিবর্তন হয়ে সদ্য লিয়াকত নাজির হাই স্কুল। স্কুলের মনোগ্রামের চারিদিকে লেখা হোল ঈমান, একতা, শৃঙ্খলা। ঈমান মানে বিশ্বাস। ইসলাম ধর্মের প্রথম শর্ত ঈমান। এখন আমার শিশু বয়সে সেই বিশ্বাসে চির ধরেছিল। তখন সব স্কুলেই একজন পন্ডিত, আর মাওলানা শিক্ষক থাকতেন। তাদের হাতে থাকতো বেত এবং কচি বাচ্চাদের পেটানোর জন্য সবসময় হাত নিশপিশ করতো। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে নেই, কিছু বুঝে উঠার আগেই সপাং সপাং দু চার ঘা পিঠে পরেই যেতো। আর পড়া না পারলে হাত পেতে বেতের ঘা নেওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সে যাই হোক, পণ্ডিত মহাশয় ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি বাংলাও পড়াতেন । মাওলানা পড়াতেন ইসলাম ধর্ম। আমাদের স্কুলে তখন দুইজন মাওলানা ছিলেন। তাঁদের নাম জানা ছিল না। সবাই বলতাম বড় হুজুর আর ছোট হুজুর। বড় হুজুর ছিলেন খুবই শান্ত, সদা হাস্য ও নম্র স্বভাবের। আর ছোট হুজুর তার ঠিক উল্টা। হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন। ছাত্রদের অহেতুক পেটানোই তার অন্যতম আনন্দ। যা হোক, প্রথমদিন আর দ্বিতীয় দিন আমার ভালোই কাটল, নবাগত হিসেবে। তৃতীয় দিনে দীনিয়াত বই সামনে রেখে বসে আছি। একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। হঠাত আমার পিঠে বেত্রাঘাত। বুঝে ওঠার আগেই বেশ কয় ঘা পড়ল, কোনও কারন ছাড়াই। তারপর বইয়ের বাইরে একটা প্রশ্ন করলেন। স্বাভাবিক কারনেই উত্তর জানা ছিল না। আবার সপাং সপাং কয়েক ঘা। এর পর থেকে শুধু আমাকেই প্রশ্ন করা হয়, আর অহেতুক পেটানো। ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলো। আমি নবাগত হবার কারনে আমার বন্ধু কেউ তখনো হয় নাই। বরঞ্চ সাবাই এড়িয়ে চলতো। কারন আমি মফস্বল শহর থেকে বড় শহরে এসেছি। একদিন শুধু আমাকে পেটানোর কারন আবিষ্কার করলাম। স্কুল ছুটি শেষে ভাবলাম ছোট হুজুরের সাথে দেখা করবো। কিন্তু তার রুমের সামনে এত ভীর কেন? ভীর হালকা হয়ে গেলে যা দেখলাম। আমি বিস্ময়ে হতবাক। ছোট হুজুরকে সবাই লাইন ধরে পান দিচ্ছে। যেহেতু পানের বিষয় আমার জানা ছিল না তাই আমি তার ক্লাসের একমাত্র ছাত্র হয়ে গেলাম যাকে তিনি বেত হাতে পড়া ধরে মানুষ করার পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিলেন। এক খিলি পান মুখে দিয়ে, তৃপ্তির সাথে ঢেকুর তুলে তিনি হয়তো ইংরেজ সাহেবের মতো বলতেন, ইট পান, ইট ইজ গুড ফর মাইন্ড রিফ্রেশিং।

পেটুকের সাথে ঘুষের অনেক মিল আছে। একজন খাওয়া প্রেমিক আর একজন ঘুস প্রেমিক। প্রচলিত ভাষায় এখন দুটোই খাওয়া। ঘুস খাওয়া আর খাবার খাওয়া। এ ব্যাপারে ছোট বেলার আরেকটি গল্প মনে পড়ে গেলো। গল্পটি নায়ক হচ্ছে হটা। হটা নামকরন হয়েছিলো কারন ও খুব খেতে পারত। কিন্তু যতই খাক না কেন সে মোটা হোত না। রোগা হোলেও খেতে পারত অনেক। যখন সে খুব ছোট ছিল, একদিন সে গেল এক বড়লোকের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে। ভারি ভারি খাইয়ে সব সেখানে খেতে বসেছে, লুচি, পড়োটা আর গোশতের ধুম লেগে গেছে। খাইয়েরা খুব খেতে পারাটাকে বড়ই বাহাদুরি মনে করে। তাই খাওয়া শেষে হবার সময় তারা বললে, ‘আচ্ছা, আজ কে সকলের চেয়ে বেশি খেয়েছে?’ এ কথায় কেউ বলছে, ‘আমি!’ আর কেউ বলছে, ‘না আমি! তা শুনে যারা পরিবেশেন করছিল তাদের একজন বলল, ‘আজ্ঞে না; সকলের চেয়ে বেশি খেয়েছে এ ছেলেটি (মানে, হটা)।’ সে ‘এতগুলো’ লুচি ‘এত টুকরো’ গোশত খেয়েছে।

সকলে তাতে ভারি আশ্চর্য হয়ে হটাকে জিজ্ঞেসা করল, ‘সত্যি নাকি তুই এত খেয়েছিস?’ হটা বলল, ‘খেয়েছি বৈকি। আরো খেতে পারি!’ তা শুনে সবাই বলল, ‘বটে? আচ্ছা আন দেখি লুচি মাংস, দেখি ও আর কত খেতে পারে। ’ তখন নাকি হটা আরো এক দিস্তা লুচি আর দুই ডজন গোশতের খেয়েছিল। এত খেয়েও যে হটার পেট ভার হয়েছিল তাও না। সে তখনই খেজুরের ডালের ঘোড়া হাঁকিয়ে বাড়ি এল, এসে কালোজাম গাছে উঠে আরো অনেকগুলো কালোজাম খেল। তখন ‘খাইয়ে’ বললে ভারি একটা গৌরবের কথা হত। সত্য মিথ্যা জানি না তবে ছোট বেলার শোনা গল্প।

আরেক গল্পের গল্পের এক ব্রাহ্মণ খাওয়ার বাহাদুরীতে মারাই গিয়াছিলেন। এক বাড়িতে তাঁকে মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করে, তাঁর যা ইচ্ছা, যত খুশি খেতে দেওয়া হত। একদিন সেখানে খেতে বসে বললেন, ‘আজ আমি শুধু ছানা আর চিনি খাব।’ তাই তাকে এনে দেওয়া হল। তিনি তখন সাতসের ছানা চেঁছেপুছে শেষ করে, বিস্তর বাহদুরি পেয়ে, বাড়ি এসে সেই রাত্রেই পেট ফেঁপে মারা গেলেন। খাওয়া তো খাওয়াই, সে ঘুষই হোক আর খাবারই হোক। পার্থক্য শুধু পেটে ভরা আর পকেটে ভরা।

একসময়, ঘুষ ছিল ঘৃণার বস্তু। কেউ ঘুষ খেলে তাঁকে বলা হত ঘুষখোর। সমীহ তো দুরের কথা তার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ছিল সবার। ব্যাপারটা এমন ছিল, ‘ছি ছি সে ঘুষ খায়?’ দিন বদলেয়েছে। আজকাল বাংলাদেশে ঘুষখোরদের সন্মানের চোখে দেখেন অনেকেই। আমি অনেক শুনেছি যে বিয়ের সম্বন্ধ সম্পর্কিত কথাবার্তায় পাত্রের জরুরী গুণাবলীর মধ্যে একটি হচ্ছে “পাত্রের ভাল উপরি আছে”। আমার কাছে বিষয়টি বোধগম্য নয় যে ঘুষকে কেন উপরি বলা হয়। কোনও এক প্রবন্ধে পড়েছিলাম, “ব্যাকরণের ভাষায় বলতে গেলে যা উপর হইতে পাওয়া যায় তাই উপরি”। কিন্তু ঘুষ কোনভাবে উপর থেকে আগমণ করে এর কোন বাস্তব প্রমাণ নেই। এ অবস্থায় এটাই অনুমান করা যেতে পারে যে ঘুষ শব্দটিকে সামান্য শ্রুতি মধুর করবার প্রত্যাশায় এ জাতীয় অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ শব্দাবলীর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উপরি আয় নিম্ন শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষেত্রে যতটা স্বাভাবিক। উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ততটাই অস্বাভাবিক। কারন তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। অফিসের অনৈতিক কাজ বন্ধ করা তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব। ঘুষ সবসময় গোপনে দেয়া হতো আগের দিনে। কারন কেউ দেখে ফেললে বেইজ্জতি কারবার। এবং তার পরিমাণও ছিল সামান্য। সবাই স্বাধীনচেতা তাই ঘুষ বাবাজির আঁতে ঘা লাগলো, তিনি বিদ্রোহ করে বসলেন। তাঁকে আর তাই গোপন রাখা গেলো না। তিনি এখন প্রকাশ্যেই আদান প্রদান হন। এবং আগের পরিমান অল্প ছিল বলেও তিনি ছিলেন মনঃক্ষুণ্ণ। তাই তার চাহিদার পরিমান এখন আকাশচুম্বী। ঘুষ অবশ্য দেশের কাজের জন্য খুবই উপকারী। যদি গরুর রচনার ফর্মুলায় ফেলা হয় তাহলে কি দাঁড়াবে? গরুর মত ঘুষের কোনও হাত পা লেজ নাই তবে গতি আছে। নিজের গতি না থাকলেও অন্যদেরকে গতিশীল করতে সাহায্য করে। সুতরাং ঘুষ একটি অদৃশ্যমান শক্তিশালী বস্তু। যাহার কোনও আকার নাই কিন্তু প্রকার আছে। যেমন, অর্থ ঘুষ, স্বর্ণালংকার ঘুষ, ফ্ল্যাট ঘুষ, জমি জিরাত ঘুষ, গাড়ি ঘুষ, বাড়ি ঘুষ ইত্যাদি অনেক প্রকার। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালি হচ্ছে অর্থ ঘুষ। এইটা অলস ফাইল বা অলস কাজকে দ্রুত গতিশীল করে। ঘুষের কারনে তিন পক্ষ উপকৃত হচ্ছে। এক সরকার, দুই ঘুষ গ্রহিতা, তিন ঘুষ দাতা। সরকার উপকৃত হচ্ছে দুই ভাবে, এক কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি থেকে রেহাই, দুই সরকারি অফিসের কাজকর্ম সাবলীল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আগে সরকারী কর্মচারীদের একটি বদনাম ছিল। অফিসে কোট ঝুলিয়ে রেখে লাপাত্তা। কোট শুধু জানান দিচ্ছে উনি অফিসে এসেছেন, তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো দেখা করার জন্য। এখন এর পরিবর্তন হয়েছে, অফিসে আসবেন কিন্তু অফিসে থাকবেন না তা কি হয়? এখন আদর্শ হচ্ছে “টাইম ইজ মানি”। সে সুবাদে এখন ফাইলের স্তূপ নাই বললেই চলে।

ঘুষের রাজ্যে, ঘুষ গ্রহীতা সবচেয়ে বেশী উপকৃত। তার মাসিক বেতনের দিকে নজর দিতে হচ্ছে না, মানে কত পাচ্ছে না পাচ্ছে তার কোনও হিসাব নাই। বারো হাত কাকরের তেরো হাত বিচির মত, বেতনের চেয়ে উপরি বেশী। বাকি জীবনটা আরাম আয়েশে ধর্মকর্ম করেই কাটিয়ে দিতে পারবে। আহ কি শান্তি। তাই তারা নিজেকে খুব চালাক এবং স্মার্ট মনে করা আর যারা ঘুষ খান না তাঁদের নরাধম সেই সাথে বোকা মনে করা। সৎ বন্ধুদের বলে, তোরা হচ্ছিস বুক স্মার্ট, আর আমরা স্ট্রিট স্মার্ট। আর যারা ঘুষ দেন তাদের একটিই উপকার, ‘কাজটি হোল’। কিন্তু পিস্তল ঠেকিয়ে ছিনতাইকারী যেমন ছিন্তাই করে ঠিক তেমনই ফাইল ঠেকিয়ে ছিন্তাই। একই ব্যাপার, শুধু একজন রাস্তায় দাড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজটি করছে, অন্যদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আছেন আর পথিক সেধে গিয়ে তাঁকে অর্থ প্রদান করছে। তাই তাঁকে ছিনতাইকারী না বলে ঘুষছিন্তাইকারী বলাই ভালো। ঘুষখোর দের মধ্যেও আবার প্রকারভেদ আছে, ছোট ঘুষখোর, মাঝারি ঘুষখোর আর বড় ঘুষখোর।

ঘুষ প্রদানের একটি ঘটনা মনে পরে গেলো, আমার এক বন্ধুর অফিসে গিয়েছি, অনেক দিন দেখা সাক্ষ্যাত নেই তাই। গল্প করছি এমন সময় তার এক কর্মচারী মুখ ভার করে তাঁকে বলল, স্যার, কাজটি হয় নাই। বন্ধুটি বলল, টাকার কথা বলো নাই? তখন সে বলল, স্যার উনি ঘুষ খান না। বন্ধুটি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘উনি কত খান না? সেটা কি জিগ্যেস করেছিলে? আহাম্মক কোথাকার, তোমরা কোনই কাজের না’।

ছোট বেলায় নানা ধরণের গল্প শুনতাম। তার মধ্যে একটি গল্প আমার ভাল লেগেছিল, এক গরু চোর খুব ভোরে অনেক দূরের হাটে যাচ্ছিলো তার চুরি করা গরু বিক্রী করতে। কারণ কাছের হাটে তো আর বিক্রি করা যায় না। তাহলে সবাই চোর ধরে ফেলবে। কয়েক গ্রাম পার হয়ে যাওয়ার পর নানা লোক গরুর দাম জিজ্ঞেস করতে লাগলো। কিন্তু গরুর দাম বেশী হওয়াতে কেউ আগ্রহী হলো না। একজন খুব করে ধরলো ভাই এই দামে আমাকে দিয়ে দিন তাহলে আপনার কস্ট করে হাটে যেতে হবে না আর আপনার সময়ও বেঁচে যাবে। সে ভাবলো হাটে এর দাম অনেক বেশী পাবে, তাই বেশী পাবার লোভে হাটের দিকে হাটা দিলো। হাটে গিয়ে দেখলো গরু কম আর ক্রেতাও বেশ অনেক। তার আশান্বিত দামের চেয়েও অনেক বেশি দাম। তারপরও তার লোভ যায় না। এই ভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেলো। অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে থাকায় তার বাথরুমে যাওয়া জরুরী হয়ে গেলো। পাশের ব্যাপারীকে বললো, ‘ভাই আমার গরুটা একটু দেখবেন ? আমি একটু আসছি’। ব্যাপারী বললো, ‘কোনো চিন্তা করবেন না, আমি দেখে রাখবো’। গরু চোর কিছুক্ষন পর ফিরে এসে দেখে ওই ব্যাপারীও নেই আর তার গরুও নেই। খুব মন খারাপ করে বাড়ির দিকে রওনা হলো। রাস্তায় ওই লোকটার সাথে আবার দেখা হলো, যে গরু কেনার জন্য খুব আগ্রহী ছিল। বললো, ‘ভাই আপনার গরু নিশ্চ্য় অনেক দামে বিক্রী হয়েছে ? গরু চোরের মেজাজ অনেক খারাপ ছিল, বললো, ভাই কোনো লাভ হয় নাই যে দামে কিনেছিলাম সেই দামেই বেঁচতে করতে হলো’।

কিছুদিন আগে একটা মাঝারি ঘুষখোরের গল্প পড়েছিলাম, গল্পটার সাথে এই গরু চোরের গল্পের অনেক মিল আছে। সেই মাঝারি ঘুষখোরের গল্প দিয়েই এখানেই ঘুষের ইতি টানছি। “এক অফিসের কেরানী জহির সাহেব। একদিন তিনি অফিসের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন। তার চোখ দুটো বন্ধ। সম্ভবত আরামে। সরকারি চাকরির আরাম বলে কথা। তাঁর সামনে কয়েকটা ফাইল খোলা। তার পাশের টেবিলেই কাজ করে সোহেল। অল্প বয়সী। এখন সৎ ভাবেই জীবনযাপন করছে। ভবিষ্যতে কি হবে বলা মুশকিল। প্রতিদিন চখের সামনে দিয়ে নড়াচড়া করছে তাকার তোরা। মাস খানেক ধরে জহির সাহেব বেশ অসুবিধায় আছেন। অফিসে সম্প্রতি সৎ বড় সাহেব এসেছেন । ঘুষ নেওয়া প্রায় বন্ধ। এজন্য অবশ্য সকাল বিকাল বড় সাহেবকে গালমন্দ দেন মনে মনে। এবার তিনিক একটু নড়ে চড়ে বসলেন। গলা একটু উঁচু করে সোহেলকে বললেন ” ঐ পার্টি কখন আসবে?” কোন পার্টির কথা বলছেন? “ঐ যে যার ছেলেটা এখানে চাকরির জন্য ঘুরছে” সোহেলের মনটা একটু খারাপ হলো। একটা গরীব ছেলে তার কাছ থেকে টাকা নিতে হবে কেন? একথা সে একবার জহির সাহেবকে বলেছিল। তিনি খেঁকিয়ে উঠেছিলেন।” ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির , যা বলি চুপচাপ শোন” এরপর সোহেল আর কিছু বলেনি। মনে মনে শুধু বলেছে “শালার ঘুষখোর”। আজ তার টাকা আনার কথা। বাইরে কোনো এক জায়গা ঠিক করা হয়েছে। অফিস তো আর নিরাপদ না। বড় সাহেব জানতে পারলে বান্দরবান বদলি। দুপুরের দিকে জহির সাহেবের কাছে একটা ফোন এলো। উনি বাইরে চলে গেলেন। ঘণ্টা খানেক বাদে উনি ফিরে এলেন। মনটা বেশ খুশি খুশি । গুন গুন করে গান গাচ্ছেন। বার বার পকেট দেখছেন। জহির সাহেব মনে মনে ঠিক করে ফেললেন আজ কি কি শপিং করবেন। সোহেল কে সাথে নিলে মন্দ হয় না, ওকেও তো এই মহৎ কাজে নিয়ে আসতে হবে। অফিস থেকে সোহেলকে তিনি সোজা নিউমার্কেটের একটা বাসে উঠলেন। তার চোখ দুটো চকচক করছে। নিউমার্কেটের সামনে বাস থামলে তিনি নামলেন। মার্কেটে ঢুকে প্যান্টের পকেটে হাত দিলেন। হাত দিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। পকেটটা কাটা। নিচ দিকে ঝুলছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, শালার পকেট মার”। যে ভাবে আমদানী ঠিক সে ভাবেই রফতানী।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৫ অক্টোবর ২০১৯/এমএম


Array