পাতিকাকের সংসার ও চামেলি বন্ধু
গোলাম মোর্তুজা
বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: কটা দিন আগেই পাতিকাক দুটি এসেছে এই লাল নীল শহরে। বুকে মৌল সাহস বেঁধে। বারুদগন্ধে ভরপুর দ্বীপের দেশ ছেড়ে। সম্পর্কের বন্ধনে ওরা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি। ওরা খণ্ডিত। বড়ই চিন্তিত। জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছে। ওদের জন্মভূমিকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনেছে, এখানকার মানুষগুলো অতিথিপরায়ণ আর আবেগি।
ব্যাঙ্গমা ওড়াওড়িতেই ভাবছে, ‘আর কোনো ভাবনার সাগরে ডুব সাঁতার না দিয়ে এবার বাস্তবতার ঘেরা টোপে ধরা দিতে হবে। আর কতক্ষণ ওড়বো। পাখনার পালক ভারি হয়ে গেছে। চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেলব যে কোনো সময়। একটু শান্ত হওয়া দরকার।’ ব্যাঙ্গমিকে নিয়ে ও থাকবে কোথায়? হাল ছাড়ার পাখিও নয়। চকাম করে আবার একটা ভাবনা এল মনে, ‘এদেশে এত গাছপালা। একটু নিচে নামি। বাড়ি বানানোর জায়গা খুঁজি। নতুন করে ঘর বাঁধবো।’
আকাশে সাদাকালো সব্বনেশে মেঘ। চারদিক আবছায়া। এমন সময়ে ফড়ফড়িয়ে দুজন নামল নিচে। সাঁই করে দেশীয় চারজন কাক এল। একজন ভার বয়স্ক কাক গলা উচিয়ে বলল, ‘তোমরা কেগো? আগে তো তোমাদের দেখিনি! পথ হারিয়েছ? নাকি ঢু মারতে এসেছ?’ দেশীয় কাকের কথা ভীনদেশীয় কাকের বুঝতে সমস্যা হয়। ভীনদেশি কাক ভড়কে গেল, চমকে গেল। বলল, না, না আমরা কারো কিছু খায়নি, নষ্টও করিনি।’ ব্যাঙ্গমার কথা শুনে ব্যাঙ্গমি বুঝেছে তার ব্যাঙ্গমা এ দেশের ভাষায় অজ্ঞ। ব্যাঙ্গমি কাক যখন সন্তান জন্ম দেবার জন্য ডিমে তা দিচ্ছিল সে সময়ে ও অবাক বিস্ময়ে বিভিন্ন কাকের সহযোগিতায় বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছে। ব্যাঙ্গমি কাকটি ব্যাঙ্গমাকে ইশারাতে থামিয়ে বলল, ‘আমরা ছিলাম ইউরোপে। আমাদের কারণে-অকারণে গুলি করে মারা হতো। বিদ্যুতের শকে মারবার জন্য তার ঝুলিয়ে রাখত। এতে প্রায় পাগলপারা-ছন্নছাড়া। একদিন ধৈর্য্যরে বাধ ভেঙে যায়। দেশের সব পাতিকাকদের নিয়ে সমাবেশ করে বলা হলো, ‘তোমরা আজকেই দেশ ত্যাগ করে জীবন বাঁচাও। নইলে ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে।’ এ কথা শুনেই উড়াল দিলাম। দিগি¦দিক ছুটলাম। আমাদের কিছু মুরব্বিরা বললেন, ‘তোমরা নিশ্চয়ই পালাচ্ছো। জীবন বাঁচাতে উড়ছো। ওদিকে না গিয়ে পেছনে গিয়ে সোজা উত্তরে যাও। ওদেশের মানুষগুলো ভালো। সবাই মিলেমিশে থাকে, খাবারের সন্ধানও পাবে আয়েসে।’ ওসব কথা শুনেই তো এলাম এদেশে।হঠাৎ আকাশ রেগে গেল। মেঘ গুড়–ম গুড়–ম করল। থমথমে মেঘে বিদ্যুৎ চমকালো। আলাপচারিতায় ন্যস্ত সকল কাকেরা কথার তুবড়ি না ছুটিয়ে একসঙ্গে এক বটগাছে স্থান নিল। বর্ণময় সে গাছে মাথা গুঁজল।
দেশীয় কাকটি বলল, ‘বুঝেছি তোমরা বিতাড়িত-অত্যাচারিত। তোমরা ইচ্ছে করলেই এখানেই থাকতে পারো। গাছের উত্তর-পশ্চিম কোণে কয়েকটি ডাল আছে।’ ব্যাঙ্গমি কাকটি দেশীয় কাকদের উদ্দেশ্যে ভদ্রতার স্বরে বলল, ‘আপনাদের কাছে আমরা ঋণী। আপনারা নেহায়েত ভালো।’ এ কথা বলেই চুপে গেল ও।
মাঝবয়সী একটি দেশি কাক এইমাত্র মেঘেদের ক্যানভাস থেকে এল এই সৌন্দর্যের সংসারে। গা ঝেড়ে, মাথার টোপর নাড়িয়ে খাবার মুখের সামনে দিয়ে বলল, ‘খাও, এগুলো খেয়ে নাও। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক’দিন না খেয়ে আছ। আমাদের এ দেশে খাবারের অভাবে কেউ মরে না। এখানকার মানুষরা অনেক কিছুই ফেলে রাখে যা খেয়ে আমরা চলছি তিনপুরুষ ধরে। তোমাদেরও চলবে। খাও। কী ভাবছ? আগে খাও পরে যা করবার কর।’ ভীনদেশি কাক দু’জনা থতমতো হলো। টাটকা বাস্তবে বাঁচবার নোঙর ধরল শক্ত করে। খেল গপাগপ্। দেশীয় কাকের আতিথেয়তায় ওরা বিমুগ্ধ।
সে রাতে কেউ-ই ঘুমোয়নি। সকালে সোনা রোদ্দুর উঠোনে আসল। এক বৃদ্ধ কাক এসে খনখনে স্বরে বলল, ‘শোন, এখন ঘর বানাও। তোমরা আর ভীনদেশি নও। এদেশ শুধু আমাদের না, তোমাদেরও। ব্যাঙ্গমি ভীনদেশি কাকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁসূচক ইশারা করল। দেশি কাকটি জোরে পাখার ঝাপটায় উড়ে গেল।
ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমি পাতিকাক দু’জনে নিজেদের মধ্যে কথার বাজার নিয়ে বসল। বাসা বানাতে হবে। কিন্তু এখানে ওরা তারার মতো ভাসে। চারদিকে নিস্তব্ধ গুমোট আবহাওয়া। ওরা হিমশিম খাচ্ছে। তবুও বাঁচতে চায়। প্রাণভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চায়। হুড়মুড় করে দুজনে মিলে বাসা বানালো খুব সুন্দর, খুবই সুন্দর করে। এবার খাবার খোঁজার পালা। বের হলো। হঠাৎ দেখে একটি দু’তলা বাড়ির পাশে একটি আমড়া গাছ। গাছের পাশে এঁদো ডোবা। চকাম করে দু’জনে বসে পড়ল একটি ডালে। ডালটি সাজানো লকলকে পাতায়। আর কিছু টসটসে আমড়ায় ভরপুর। ওগুলো দিয়ে ওদের কোনো কাজ নেই কিন্তু গাছের পাশে থাকা ডোবায় ওরা গোসলটা সেরে নিতে চায়। বেশ কটা দিন থেকে নাওয়া-খাওয়ার কোনো নিয়ম নেই। শরীররটা থেকেও বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে।
দু’তলা বাড়িটি শফি সাহেবের। স্ত্রী রাফিয়া। একমাত্র মেয়ে চামেলি। বয়স পাঁচ। মেয়েকে খাওয়াতে ব্যস্ত। চামেলি খায় না। মা রাফিয়া চামেলিকে বেলকনিতে চেয়ারে বসালেন। চামেলি উঠে দাঁড়ালো। ভাত মুখে পুরে দিলেন মা রাফিয়া। চামেলি ওয়াক করে মুখের ভাত ফেলে দিল গ্রিল দিয়ে। ভাত পড়ল কার্নিশে। ভীনদেশি কাক দু’জনা তখন গাছের চিরল চিরল পাতাময় ডালে। চামেলিও কাকের দিকে তাকিয়া আ আ রবে ডাকলো। মা রাফিয়া মেয়ের মুখে আবার ভাত দিলেন। এবার চামেলি ভাত খাচ্ছে। ভীনদেশি কাকও কার্নিশে গিয়ে খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে কা কা করে ডাকছে। চামেলি ভাত খেতে খেতে থালা থেকে ভাত তুলে কাকের উদ্দেশে ফেলছে।
অস্তমিত দুপুর। মরা গাঙে ভেসে ওঠা ক‚লের মতো চামেলির খাওয়ার শেষ রেখা স্থিমিত হলো। রাফিয়া বেগম জানেন মানুষের কথা মানুষ না বুঝলেও পশু-পাখিরা বোঝে।
তাই তিনি কাকের উদ্দেশে বললেন, ‘কাল আবার আসিস। তোদের জন্য যখন আমার মেয়েটা আনন্দে-আহ্লাদে খেল। তাই তোরা আজ থেকে ওর বন্ধু।’ ভীনদেশি কাক দু’জনে কা কা রবে বলল, ‘তোমরা এত ভালো। আমাদের খাওয়াতে চাও। যে দেশে ছিলাম ওরা সবাই দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতো। নাগিনীর মতো ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করত। আসলেই মানুষই সুখ-মানুষই যন্ত্রণা।’ কাকের কথা বুঝবার ক্ষমতা রাফিয়া বেগমের নেই। তবুও তিনি বুঝেছেন ওরা আসবেই-আসবে।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ এমএম