বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দারুণভাবে এগিয়ে চলেছে। দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে ১০টি। নয়টি কনভেনশনাল ব্যাংকের রয়েছে ১৯টি ইসলামী ব্যাংকিং ব্রাঞ্চ। আর সাতটি কনভেনশনাল ব্যাংকের রয়েছে ২৫টি উইন্ডো। ২০১৮ সাল শেষে দেশের সব ব্যাংকের সর্বমোট শাখা রয়েছে প্রায় ১০,২৮৬টি।
এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সর্বমোট শাখা ১,২৪১টি। এর সঙ্গে আমাদের আইএফআইএলের আটটি ও হজ ফাইন্যান্সের তিনটি মিলিয়ে আরও নয়টি শাখা যোগ করতে হবে। আরও অনেক কনভেনশনাল ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য বা ইসলামী শাখা ও উইন্ডো খোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে রেখেছে। কাজেই ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে এ সংখ্যা ক্রমেই আরও বাড়বে।
অন্যদিকে দেশের সর্বমোট ব্যাংকের ডিপোজিট হল প্রায় ৯,৬৮,৩০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সর্বমোট ডিপোজিট ২,২৪,৭৫৭ কোটি টাকা। মোট ডিপোজিটের সংগ্রহে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অংশগ্রহণ ২৩.৩০ শতাংশ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব ব্যাংকের বিনিয়োগ হল ৯,৬০,৪৬২ কোটি টাকা।
মোট বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অংশগ্রহণ ২,৩০,৯০৭ কোটি টাকা বা ২৪.০৪ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অবদান এখন অনস্বীকার্য এবং অর্থনীতিতে মোট ব্যাংকিং সেক্টরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। উল্লেখ্য, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রায় ৪৩ শতাংশ রেমিটেন্স আসে, ২০১৮ সালে যা ছিল প্রায় ১৩,০৭৫ কোটি টাকা।
ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (আইএফআইএল) দেশের প্রথম ও শীর্ষ শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। বর্তমানে এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ‘এ’ ক্যাটাগরির একটি কোম্পানি। পোর্টফোলিও সাইজ, প্রবৃদ্ধি, আয় ও মুনাফায় প্রতিষ্ঠানের অবস্থান মাঝামাঝি সারিতে। তবে স্থিতিশীলতায় ও ধারাবাহিকতায় বেশ এগিয়ে।
আরেকটি বিষয়, ইসলামিক ফাইন্যান্সের কিছু ইউনিক অফার রয়েছে, যেগুলো গ্রাহকরা বেশ অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, আপনি এখানে ১ লাখ টাকা আমানত রাখলেন। এর বিপরীতে এখান থেকে ৮০ হাজার টাকা আবার ঋণ হিসেবে নিলেন। অন্য জায়গায় আমানত ও ঋণের সুদহারে একটি ব্যবধান থাকে, যার ভিত্তিতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আপনাকে একদিকে সুদ বা মুনাফা দেয়, অন্যদিকে তা চার্জ করে। আইএফআইএল ১ লাখ থেকে ৮০ হাজার বাদ দিয়ে শুধু ২০ হাজার টাকার ওপর আপনাকে মুনাফা দেবে। হিসাব করে দেখবেন, এখানে আপনি বেশি মুনাফা পাচ্ছেন।
ম্যানুফ্যাকচারিং বা সেবায় আইএফআইএলের অর্থায়নের কৌশলটিও পরিশ্রমী ব্যবসায়ীরা পছন্দ করেন। ধর্মীয় কারণে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কাছে শরিয়াহভিত্তিক ফাইন্যান্সের আবেদন রয়েছে। এছাড়া আইএফআইএলের পণ্য ও সেবাগুলোয় কিছু সুবিধা রয়েছে, যেটি অন্য ধর্মের গ্রাহকরাও পছন্দ করেন। এখানে অমুসলিম গ্রাহকও রয়েছেন।
আইএফআইএল শরিয়াহ নির্দেশিত মুদারাবা পদ্ধতিতে সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ করে এবং ব্যবসায়ের ধরন বুঝে শরিয়াহ অনুমোদিত বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে থাকে। এছাড়াও মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের আমানতদার হিসেবে সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চালনসহ বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্যবিমোচনের মতো বিশেষ বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার দাবি রাখে।
বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশে ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের রয়েছে অপরিসীম সুযোগ; কারণ এখানে অধিকাংশ মানুষ সুদমুক্ত হালাল রুজিতে বিশ্বাসী। আর আইএফআইএল সেই পথকে সহজ ও প্রশস্ত করেছে। এজন্য ভবিষ্যতে এর কার্যকারিতা আরও ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। ইসলামী অর্থায়নের উপযোগিতা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
ইসলামিক ফাইন্যান্স ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় স্টক এক্সচেঞ্জেই ‘এ’ ক্যাটাগরিতে আছে। ক্রেডিট রেটিংয়ে আইএফআইএল স্বল্পমেয়াদে এসটি-২, দীর্ঘমেয়াদে ‘পজিটিভ’ এবং ক্যারেন্ট রেটিংয়ে ‘এ’ অবস্থানে। ২০১৫ সালে ১৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ, ২০১৬তে ১৪ শতাংশ, ২০১৭তে সাড়ে ১৪ শতাংশ লভ্যাংশ এবং গত বছর ১৪.৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে। অতএব বলা যায়, প্রবৃদ্ধি, ব্যবসা সম্প্রসারণসহ সবক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ও ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। তবে ব্যবসার আকার ও কলেবর দুটিই বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে আইএফআইএল (তিনটি) নতুন প্রোডাক্ট চালু করেছে। প্রোডাক্টগুলো হল ‘মুদারাবা আসান ডিপোজিট স্কিম’, ‘রাহা’ (কমফোর্ট) ও ‘সিলা উল ইসতিহলাক’ (কমোডিটি)।
ঋণে দুটি নতুন প্রডাক্ট চালু করা হয়েছে। একটি হচ্ছে ‘রাহা (কমফোর্ট)’, যার মাধ্যমে আমদানি এলসি খোলায় গ্রাহককে ‘লেটার অব কমফোর্ট’ দেয়া হবে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এলসি খুলতে পারে না; কিন্তু অনেক গ্রাহক আছে যাদের আমদানির প্রয়োজন হয়। এজন্য আইএফআইএল এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ লেটার অব কমফোর্ট হচ্ছে গ্রাহকের পক্ষে একধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়া, যে কোনো কারণে গ্রাহক আমদানি দায় সময়মতো পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার পক্ষে আইএফআইএল পরিশোধ করবে। আরেকটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে দেশে উৎপাদিত পণ্য কেনার জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘সিলা উল ইসতিহলাক’ (কমোডিটি)।
সবচেয়ে উদ্ভাবনী শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইএফআইএল অর্জন করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৮’। সম্প্রতি দুবাইয়ে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কারটি দিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইউকে’। এ পুরস্কার সম্মানের দিক থেকে আমাদের আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।
বর্তমানে দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খেলাপি ঋণ, তারল্য ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন। এসব চ্যালেঞ্জের কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাত একধরনের সংকটকাল অতিক্রম করছে। খেলাপি ঋণ এবং তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় আছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে (২০১৮ সালে) পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯৩,৯১১ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে যা ছিল ৭৪,৩০৩ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এক বছরেই বেড়েছে ১৯,৬০৮ কোটি টাকা বা ২৬.৩৮ শতাংশ। অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। অবলোপনকৃত পুরনো খেলাপি ঋণ আদায় কম হচ্ছে, আমদানি বেড়েছে এবং টাকার তুলনায় ডলারের তেজি অবস্থা একটি সাময়িক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে এবং যথাযোগ্য নির্দেশনায় আমরা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে পেরেছি।
সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি NBFIগুলোর জন্য ব্যাপক ইতিবাচক সম্ভাবনা ও অবারিত সুযোগ বিদ্যমান। বাংলাদেশের মৌলিক অর্থনীতিতে নিবিড় ও সুপরিকল্পিত অর্থায়নের মাধ্যমে দেশের সামাজিক ও আর্থিক খাতে ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের আমানতদার হিসেবে সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চালনসহ বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্যবিমোচনের মতো বিশেষ বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার দাবি রাখে।
বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশে ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের রয়েছে অপরিসীম সুযোগ। কারণ এখানে অধিকাংশ মানুষ সুদমুক্ত হালাল রুজিতে বিশ্বাসী। আর আইএফআইএল সেই পথকে সহজ ও প্রশস্ত করেছে। এজন্য ভবিষ্যতে এর কার্যকারিতা আরও ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। ইসলামী অর্থায়নের উপযোগিতা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন ‘ব্যাংক ফর ইন্টারন্যশনাল সেটেলমেন্ট’, ‘ব্যাসেল কমিটি’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স’-এর প্রবর্তিত নীতিমালা পরিপালনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতকে একটি মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে ব্যাংকিং খাতকে মুক্ত করে, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে জোর দিয়ে এবং ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্পোরেট কালচারের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে আর্থিক খাতের অপরিসীম উন্নয়ন সম্ভব।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে চিহ্নিত। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে আমরা যোগ্যতার সঙ্গে টিকে আছি। আগামী দিনগুলোতে গার্মেন্ট, আইটি, পাট, শস্য, মাছ ইত্যাদি খাতে আমাদের আরও অনেক ভালো করার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কেননা বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতির সব ম্যাক্রো ইন্ডিকেটরের ইতিবাচক ধারা লক্ষণীয়।
আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিক এবং প্রশংসনীয় স্থিতিশীলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। সরকার গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলো (পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্রবন্দর, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প, ভাসমান এলপিজি টার্মিনাল ইত্যাদি) বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের একটি উন্নত দেশে উন্নীত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
ব্যাংকিং খাতে শুধু নেতিবাচক দিক আছে এমন নয়, এ খাতের অনেক অর্জনও রয়েছে। গ্লোবাল টার্গেট থেকে শুরু করা যায়, যেমন এসডিজি। এখন প্রশ্ন, এসডিজির কনটেক্সটে আমাদের ব্যাংকিং খাত কতটুকু প্রস্তুত? এসডিজির কোন কোন লক্ষ্যের সঙ্গে ব্যাংকিং খাত যুক্ত? দেখতে হবে আমাদের অর্জন কতটুকু। আমরা আরও কী করতে পারি। এগুলো নিয়ে ব্যাংকিং খাতের যেমন অর্জন রয়েছে, একই সঙ্গে এ খাতের বিস্তৃতি ঘটেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবা, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো অর্জন রয়েছে।
আবু জাফর মো. সালেহ্ : ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (আইএফআইএল)।
বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৬ মে ২০১৯/ এমএম