আহসান রাজীব বুলবুল, প্রধান সম্পাদক, প্রবাস বাংলা ভয়েস :: সজনী গো ভালবেসে এত জ্বালা কেন বলো না, …..চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে…, আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই…, সন্ধ্যারও ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়া.. বাংলা সিনেমার কালজয়ী জনপ্রিয় এই গানগুলো এখনো বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গাঁথা।
ভালোবাসা,আবেগ আর বাস্তব জীবনের দুঃখে কষ্টে ভরা গানগুলো যেন প্রজন্ম-থেকে প্রজন্মতরে প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে। ভাবাবেগ আর হৃদয়আপ্লুত গানগুলোর স্রষ্টা, কাব্যিক গানের অসম্ভব মেধাবী গীতিকার, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, জনপ্রিয় গানের জগতের সম্রাট, কালজয়ী বাংলা গানের গীতিকবি, স্বনামখ্যাত গীতিকার চলচ্চিত্র প্রযোজক মাসুদ করিম-এর আজ ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।
করোনা ভাইরাসের কারনে এ বছর অনাড়ম্বর কোন অনুষ্ঠান না হলেও কানাডার আলবার্টার স্থানীয় গণমাধ্যম”প্রবাস বাংলা ভয়েস” এর আয়োজনে ক্যালগেরিতে ভার্চুয়ালি আয়োজন করা হয় মরহুমের স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা অনুষ্ঠানের। প্রধান সম্পাদক আহসান রাজীব বুলবুল এর সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন নন্দিত কালজয়ী মরহুম গীতিকার মাসুদ করিম এর সহধর্মিণী এবং তার পরিবারের সদস্যরা।
মাসুদ করিমের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার সহধর্মিণী ও সঙ্গীতশিল্পী দিলারা আলো আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন– স্মৃতি কথা কয়, প্রতি নিয়ত! আজকের দিনে মনের মাঝে কত শত স্মৃতির আগমন আমাকে কাঁদায়, আবার হাসায়! কত স্মৃতি, স্বর্ণালী সময় আমরা অতিবাহিত করেছি,আমার হাতের রান্না রুই মাছ খুবই পছন্দ করতে তুমি! এখন রুই মাছ খেতে গেলে চোখ দুটো ভিজে যায় ..! চট্টগ্রাম রেডিও অফিসে গরম গরম সিংগারা মজা করে খেতাম দুজনে… তখন আমাদের ভালেবাসার সূচনা! মুখে হাসির ফোয়ারা … দিন গুলো আজও আমার সাথে কথা বলে… আমি তোমাকে অনুভবে পাই মাসুদ।
মেয়ে ফারজানা আলো কনক বলেন–আমার বাবা আমার কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ছোট বেলা থেকেই বাবার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি।স্মৃতি মনে পড়তেই চোখ ভিজে যায়, ছোটবেলায় বাবার অপেক্ষায় মেহেদি গাছের উপরে বসে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতাম বাবার ফেরার অপেক্ষায়।দূর থেকে যখন আব্বাকে দেখতাম খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। আব্বা চশমাটা ঠিক করে গাছ থেকে আমাকে নামিয়ে কোলে নিত।আজো যখন জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি,মাঝে মাঝে মনে হয় যদি আব্বাকে দেখতাম সেই আগের মতো।
ছেলে মাহবুবুল করিম সোহেল বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন– বাবা যখন কানাডার মন্ট্রিলে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছিলেন, তখন তিনি তাঁর শৈশবের অনেক স্মৃতি তুলে ধরতেন। জীবনের শেষ দিনগুলিতেও তিনি কুষ্টিয়ার সেই গড়াই নদীর তীরে সাঁতার কাটা, গাছ থেকে আম পাড়া, ছেলেবেলার ফুটবল খেলা গাঁয়ের মেঠো পথে চারদিকে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিচারণ করতেন। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত বাবা দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। মাতৃভূমির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম।
মেয়ে রওশান জাহান করিম সিনথিয়া বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন–“আমার আব্বা মাসুদ করিমকে আমি বেশী অনুভব করি যখন আমি চোখ বন্ধ করে গান শুনি। কারন আব্বাও গান শুনতেন চোখ বন্ধ করে। আব্বা আজ নেই, চোখ বন্ধ করে গান শোনার সময় মনে হয় আব্বা আমার পাশে আছে.. কান্না করি শুধু ..”।
নাতনি ফাতিহা রেজওয়ান প্রেমা নানার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন–সাড়ে তিন বছর বয়সে নানাকে হারাই। আমার সৌভাগ্য যে নানার সাথে আমার কথোপকথন নানা রেকর্ড করেছিলেন যা আমি প্রতিনিয়ত শুনি। নানা আমাকে গল্প শোনাতেন আর উৎসাহ দিতেন গল্প বলতে যা তিনি মন দিয়ে শুনতেন। আজ আমি গল্প গান আর কবিতা লিখি যার প্রথম অনুপ্রেরণা ছিল আমার নানা। যখন আমি লিখি নানার চশমা আমার সামনে থাকে মনে হয় নানা আমার লেখা দেখছেন চোখ বন্ধ করে।
উল্লেখ্য ষাটের দশক থেকে ঢাকা শহরে যে শুদ্ধ সংগীতের জগৎ তৈরি হয়েছিল, মাসুদ করিম ছিলেন সে জগতের একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য। নিজের সৃজনশীল কর্ম দিয়ে তিনি, নিজেকে নিয়ে গেছেন সংগীতের এক অনন্য উচ্চতায়। জনপ্রিয় এই গীতিকার- রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, আধুনিক, দেশাত্ববোধক, পল্লীগীতি-সহ বাংলা গানের বিভিন্ন শাখায় সহস্রাধিকের মত গান লিখেছেন।তাঁর লেখা ৮০০ গান নিয়ে ‘৮০০ গানের সংকলন : মাসুদ করিম’ নামে একটি গ্রন্থ, প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী দিলারা আলোর সম্পাদনায়, অনন্যা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
মাসুদ করিম ১৯৩৬ সালের ২৭ শে জুন, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার, দুর্গাপুর কাজীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রেজাউল করিম একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন এবং মা নাহার ছিলেন গৃহিনী।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ঢাকা এবং চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্রে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। কয়েক বছর পর তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দান করেন।
মাসুদ করিম ১৯৬০ সালে, ঢাকা বেতার এবং টেলিভিশনের গীতিকার হিসেবে যোগ দেন। একসময় তিনি চলচ্চিত্রের জন্যও গান রচনা করেন।
বাংলা সিনেমার জন্য তিনি লিখেছেন একের পর এক কালজয়ী গান। প্রায় প্রতিটি গানই জনপ্রিয় হতে থাকে বাংলার মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে। তার লেখা গানগুলোর উল্লেখযোগ্য সিনেমা হলো– রূপবান, মধুমিলন, ইয়ে করে বিয়ে, তানসেন, যাদুর বাঁশি, রজনীগন্ধা, মায়া মৃগ, দুই পয়সার আলতা, লালু ভুলু, পুত্রবধূ, ঘরণী, ওয়াদা, অনুরাগ, রাজদুলারী, অগ্নি কন্যা, আওয়ারা, অবদান, টাকার অহংকার, নিয়তি, আকর্ষণ, সাজানো বাগান, সবার উপরে, প্রায়শ্চিত, ভাঙ্গাগড়া, বিসর্জন, মহানায়ক, রামের সুমতি, আগমন, ব্যাথার দান, গরীবের বউ, প্রিয় তুমি, শিল্পী, হৃদয় থেকে হৃদয়, দেনমোহর, এবং সত্যের মৃত্যু নাই’ সহ আরো অনেক ছবিতে।
সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। এরমধ্যে ‘রজনীগন্ধা’ এবং ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ ছবির জন্য, শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন মাসুদ করিম। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন থেকে অনেক সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন।
ব্যক্তিজীবনে মাসুদ করিম ১৯৬৫ সালে, দিলারা আলোর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দিলারা আলো একজন স্বনামধন্য কন্ঠশিল্পী। এই দম্পতির এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। মেয়েরা হলো- কনক, কান্তা, সিনথিয়া আর ছেলে- সোহেল।
খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় গীতিকার মরহুম মাসুদ করিমের কালজয়ী গানে দেশ-বিদেশের অনেক নামকারা সুরকারেরা তাঁর রচিত গানে সুর দিয়েছেন এবং বিখ্যাত সব কন্ঠশিল্পীরা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। মাসুদ করিম ‘ইউনিক’ নামে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি কয়েকটি সিনেমাও প্রযোজনা করেছেন। তাঁর প্রযোজিত বাংলা ছবি গুলোর মধ্যে- অচেনা অতিথি, ওয়াদা এবং ভালো মানুষ অন্যতম।
তন্দ্রা হারা নয়নও আমার…, শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাবো…, যখন থামবে কোলাহল নিঝুম চারিদিক…সহ অসংখ্য গানের রচয়িতা সকলের কাছে অতি জনপ্রিয় নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, সাদা মনের মানুষ, গানের জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাসুদ করিমের কোলাহল থেমে যায় ১৯৯৬ সালের ১৬ই নভেম্বরে, ষাট বছর বয়সে, তিনি চির নিদ্রায় শায়িত হন কানাডার মন্ট্রিয়ালে।।
কীর্তিমানের মৃত্যু নাই–তিনি হাজার বছর বেঁচে থাকবেন তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে।
কানাডার আলবার্টার প্রথম বাংলা অনলাইন প্রবাস বাংলা ভয়েস এর পক্ষ থেকে আমরা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ১৭ নভেম্বের ২০২০/এমএম








