মো. মাহমুদ হাসান, ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা :: একটি বদলি আদেশ, অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (OSD) হওয়ার আদেশ যে কোন দেশের সরকারে প্রজাতন্ত্রের নিয়মিত কাজেরই অংশ। আমাদের প্রজাতন্ত্রে শিক্ষা ছুটি, প্রমোশন পরবর্তী অপেক্ষমান ইত্যকার সময়ে সরকারি আমলাদের ওএসডি করার বিধান আছে, আবার কাউকে নীতি, নৈতিকতা ও আদর্শিক চেতনায় সমমনা না হলে কর্মহীন করার প্রয়াসে ওএসডি করার বহুল প্রচলিত রেওয়াজ ও চালু আছে। উন্নত সমাজে সৃষ্টিশীল মেধাবীদের বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে ওএসডি করা হয়ে থাকে। জনাব মাহবুব কবীরের ক্ষেত্রে কোনটি হয়েছে, সরকারি সিদ্ধান্তের কোন ব্যখ্যা না জেনেই তাহলে, কেন আমাদের এত হৈচৈ?
একি আমাদের হতাশাগ্রস্ত সমাজের না পাওয়ার বেদনায় পুঞ্জীভূত হাহাকার নাকি সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী নীতি-কৌশলের ধারকদের প্রতি কোন ধরনের অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ অথবা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার ঐতিহাসিক ধারক, একমাত্র আশ্রয়স্থল, বটবৃক্ষ সদৃশ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান টির প্রতি বহুমাত্রিক প্রত্যাশার ব্যর্থ প্রতিফলন।
জন্মলগ্ন থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী অতিক্রম করলেও প্রিয় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র এখনো তার উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত ধ্যান ধারনা থেকে বেরিয়ে এসে জনমুখী হতে পারেনি, সাহেব-গোলামী ভাবনার উপনিবেশিক নীতি-কৌশলে কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমলারা যেমন প্রচলিত ধারাতেই তৃপ্ত, তেমনই জনগন লালফিতার দৌরাত্ম্যে চরমভাবে অতৃপ্ত ও ক্ষুব্দ। শেষ ভরসার রাজনীতিকরা ও আজ অনেক ক্ষেত্রেই জনবিচ্ছিন্ন, আদর্শের ধারক রাজনীতিকরা চরমভাবে পরাভূত, হতাশায় নিমজ্জিত। পূরনো দিনের একটি অভিজ্ঞতা কে আমাদের আমলাতন্ত্রের রুপ বিশ্লেষণে ব্যবহার করতে চাই। ১৯৮৪ সাল, সামরিক শাসকের দুর্দান্ত প্রতাপ, এমনই এক দিনে কিছু যৌক্তিক দাবি নিয়ে সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতা আবু জাহির ( সংসদ সদস্য), প্রবাল মোদক সহ আমরা কিছু সংখ্যক ছাত্র নূতন জেলা হবিগঞ্জ এর প্রথম প্রশাসক জনাব নাজিম উদ্দীন মহোদয়ের সংগে দেখা করতে গিয়ে বুঝতে পারি, গুরুগম্ভীর পরিবেশে আরামদায়ক কেদারায় বসা একজন আমলার সংগে পূর্ব নির্ধারিত সূচী বিহীন সাক্ষাত করা কত বড় অন্যায় হয়েছিল। ব্যতিক্রম তখনও ছিল, পাশের কক্ষে বসা তরুণ অফিসার এনডিসি ম্যাজিস্ট্রেট এম এন ছিদ্দিক (পরবর্তীতে সচিব, সম্ভবত মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিচালক) সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন, আমাদের আবেদনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন, জনবিচ্ছিন্ন আমলাতন্ত্রের রুপ-তামাশা কে ও ব্যখ্যা করেছিলেন।
আজও সেই পরিস্থিতির যে আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে, তা বলার অবকাশই বা কোথায়? সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধ, সে তো আজ চরমভাবে পরাভূত, যা এতো বছর পরে জাতির জনকের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ শাসন আমলে একযুগ পেরিয়ে গেলেও, এখন ও তার অব্যাহত ব্যপ্তি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুংকারে জি কে শামীম, সম্রাট রা গ্রেফতার হলেও নাম বিভ্রাটে জামিন পায়, পিজি হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বহাল তবিয়তে তাদের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত থাকে, রুপনদের ঘরে বস্তায় বস্তায় টাকা জনগণ কে ব্যথিত করে। প্রগতিশীল আওয়ামীলীগের চির শুভাকাঙ্ক্ষী দুঃসময়ের কলমযুদ্ধা বুদ্ধিজীবিরা, মহানায়ক শেখ মুজিব এর সোনার বাংলার প্রত্যাশায় সত্য বললে, রাজাকারের তকমা লাগে। এমন ত্রিশংকুল পরিস্থিতিতে আমজনতা যাবে কোথায়?
ইদানিং কালের পরিক্রমায়, আমরা কিছু জনমূখী আমলার নানাবিধ দৃষ্টান্তমূলক নৈতিক প্রচেষ্টাকে দেখতে পাই। উপনিবেশ আমলে প্রনীত, তথাকতিত নীতি কৌশল অব্যাহত থাকলেও, সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের কে, বহুবিধ হতাশায় আচ্ছন্ন জাতির ভরসাস্থলে পরিনত করে।
মাহবুব কবীর বাংলাদেশ সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব। সরকারের নীতিকৌশল এর সঠিক বাস্তবায়নই উনার কাজ। যতদূর জানা যায়, যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, নৈতিকতা, একাগ্রতা, দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট হয়ে হাজারো রকম সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছেন। কিছুটা ভয় আর কিছুটা শংকা নিয়ে ই সামাজিক মাধ্যমে দুর্নীতি অবসানে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিন মাসের বিলাসী পরিকল্পনার কথা বলেছেন। নানাবিধ জরাব্যধিতে আক্রান্ত, হতাশায় নিমজ্জিত জাতি জনাব মাহবুব কবীরের বক্তব্যে আশার আলো খুজতে ছেয়েছেন। যুগ যুগের ব্যবধানে সৃষ্ট এমন কোন সামাজিক সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়, তবুও উনার সদিচ্ছা নিয়ে আমার কোন সংশয় নেই।
ফেসবুকে হাজার হাজার শেয়ার, বিবিসি বাংলা সহ সকল প্রথম শ্রেণির বাংলা গণমাধ্যমে জনাব মিলনের বদলী আদেশের প্রতিবাদে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার সংবাদ কিসের ইংগিত বহন করে? র্যাব ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার, এক সময়কার এয়ারপোর্টে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট বানসুরী ইউসুফ কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন? এই জনপ্রিয়তা কি তাদের কোন অপরাধ? নাকি নীতি কৌশল এর প্রবক্তা সদাসয় সরকারের প্রতি আশাভংগের বেদনায় নিমজ্জিত জাতির ব্যতিক্রমী আশ্রয়!!
অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিবেচনায় প্রিয় দেশের আশাতীত সাফল্য থাকলেও সামাজিক বৈষম্য, মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় সামষ্টিক উন্নয়নে সাম্প্রতিক কালের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কঠিনতর সময়ে মান্ধাতা আমলের আমলাতান্ত্রিক বিধিবিধান দিয়ে মাহবুব কবীর মিলন, আকতার হালিম দের মতো মানুষদের থামিয়ে দিলে অমানিশার অন্ধকার আরও দীর্ঘায়িত হবে। আটারো কোটি মানুষের দেশে অগনিত এনু, রুপন, আফজল, পরিমল, বেসিক বাচ্চু ঘুরে বেড়াচ্ছে। কানাডার মতো বেগমপাড়া গুলোতে জনতার ঢল বেড়ে ই চলেছে। নিদেনপক্ষে আটারো হাজার মাহবুব কবীর মিলন, সারোয়ার আলম, সৃষ্টি করতে পারলেই জাতির জনকের সোনার বাংলা তরান্বিত হতে পারে, আসতে পারে বহু আকাংখিত সোনালী সাফল্য, হতে পারে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, আলোকিত সমাজব্যবস্থা।
লেখক : সাবেক উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
অগাস্ট ৮, ২০২০
প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/১১ আগস্ট ২০২০/এমএম





