Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন মাটিরঘর। কেউ কেউ মাটিরঘরকে শান্তির নীড় বা বালাখানাও বলে থাকেন। এক সময় গাঁও-গ্রামে দৃষ্টিনন্দন মাটিরঘর ছিল। আর মাটিরঘর দেখতে হলে গাঁও-গ্রামেই যেতে হয়।

যেমন- নারায়ণগঞ্জের মহজমপুর, ললাটি, নানাখি, রূপগঞ্জ, বেরাইদা, গাউছিয়া, ধুপতারা, কালিবাড়ি, মাধবদী, সাভার, পার্বত্যচট্টগ্রাম, রাজশাহীর তানর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম, নাটোরের সিংড়া, রংপুরের মধুপুর ও যশোরের মনিরামপুর গ্রামে দ্বিতল মাটির ঘর এখনও টিকে আছে; যা লক্ষ করা যায়। ঘরগুলো দেখতে মনোরম। পরিবেশবান্ধব ঘর বলে অনেকে বিমুগ্ধও হন।

সাম্প্রতিকালে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে অনেক এলাকায় ঘুরে-ফিরে দেখেছি। সে কথা মনের গহিনে আচমকা অনুভূতি অনুভব করি। রংপুর, বগুড়া, গাইবান্ধার কামারজানি ও নারায়ণগঞ্জের আশপাশের এলাকায় লালমাটির প্রলেপের তৈরি দৃষ্টিনন্দন মাটির ঘর নজরে পড়ে। জনশ্রুতি আছে, মাটির ঘর গরিবের বালাখানা।

এটি পুরনো ঐতিহ্য। যখন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যায় বা খোয়া যায় তখন তার কদরও বেড়ে যায়। ইতিহাসের ঝুড়ির দিকে তাকালে মক্কায় হজরত আলী (রা.) স্ত্রী, নবী নন্দিনী হজরত ফাতেমা (রা.) তিনিও মাটিরঘরে জীবনযাপন করেছেন। এ মানবীর জীবনীও লক্ষণীয় এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় আমাদের দীক্ষা দেয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম রাজ্যে কামরূপ কামাখ্যায়ও চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির মাটির ঘর।

এরই ধারাবাহিকতায় গাঁও-গ্রামের মাটিরঘরে সংসার জীবন এখনও টিকে আছে। এ মাটির ঘর ঝড় ও বৃষ্টিতে ক্ষতি কমই হয়। পাশাপাশি এ ঘর গ্রীষ্মকালে শীতল হাওয়ায় প্রাণ জুড়ায়। মাটির ঘরকে প্রাকৃতিক শীতল বলে এসিও বলে থাকে। আবার শীতকালে শীতের প্রভাব অনেক কমও হয়। এক সময় ছনের ঘর ছিল।

পিঁড়া গোবর দিয়ে নিয়মিত যত্ন নেয়ায় ওই ঘর বহু বছর টিকে থাকত। আগের মতো মাটির ঘর এখন আর চোখে পড়ে না। মো. মোতাহার হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়াসহ তিনজনে মিলে সকাল থেকে গোধূলি পর্যন্ত নানা এলাকা ঘোরাঘুরি করে দেখেছি।মহজমপুর গ্রামের জামদানি পল্লীর শিল্পী মো. আ. হালিম ও ওম্মে হাবিবা এ দম্পত্তির কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, চৌদ্দ পুরুষ মাটিরঘরে বসবাস করে জীবন তরীয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। গ্রামের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এসেছে; ছেলেরা দেশ-বিদেশে আছে বলে তাদের ভাগ্যের কিছু পরিবর্তনও ঘটেছে।

১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় গ্রামের অনেক মাটির ঘর ভেঙে গেছে; যা টিকে আছে তা-ও ভেঙে পাকা বাড়ি করার প্রথা চালু হয়েছে। ওই গ্রামের ঐতিহ্যের বাঁধন ছিঁড়ে পরিবেশ তাদের বাধ্য করেছে ইটের তৈরি ছোট-বড় দালান নির্মাণ করতে। অভাবী মানুষের মনকে ব্যাকুল করেছে। গাঁও-গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ বোঝেন না এনজিও কী? তারপরও এনজিওর দ্বারস্থ হয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বর্তমানে তৈরি করছে ছোট ছোট ইটের তৈরি দালান ও টিনশেড। এ ঋণের টাকা পরিশোধ করাও দায়ে পোহাতে হয় অনেক পরিবার পক্ষে। কেউ কেউ লালমাটির নির্মাণশৈলীতে ঘরগুলো তৈরি করছেন। এ ঘর তৈরি করা হয় কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে।

যারা মাটির ঘর নির্মাণ করেন তাদের ‘দেল বারুই’ বলে। কিন্তু কালের আবর্তে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মাটির দ্বিতল ভবনও। মজার বিষয় হল গরম মৌসুমে আরামদায়ক বলে গরিব মানুষের পাশাপাশি অনেক ধনী ব্যক্তিও বিগত আমলের এ মাটির ঘর নির্মাণ করছেন। চোখ ঘুরিয়ে দেখি নানা জাতের আম, জাম, কাঁঠাল ও ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে।

বসবাসকারী ব্যক্তিরা বলেন, জন্মসূত্রে মাটির তৈরির বাড়িঘর পেয়েছি। বাপ, দাদা পূর্ব পুরুষও জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাইতো এখনও পূর্ব পুরুষের রেওয়াজ অনুযায়ী ভাঙেননি মাটির ঘর। ভাঙতে চান না কেউ কেউ। দ্বিতল ঘরগুলোর ওপরের তলায় উঠতে কাঠের সিঁড়ি, বাঁশের তৈরি সিঁড়ি অনেকে ব্যবহার করেন। আবার মাটির সিঁড়িও কেউ কেউ তৈরি করে দ্বিতল ভবনে। একটি ঘর তুলতে শ্রম আর সময় গুনতে হয় কমপক্ষে তিন-চার মাস। খরচও কম নয়। এ মাটির ঘর ভালোভাবে নির্মাণশৈলীতে খরচ বাবদ গুনতে হয় প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। একটি ঘর নির্মাণ করা কষ্টও কম নয়।

এক সময় মাটিরঘরের কথা ইতিহাস হয়ে থাকবে; স্মৃতি খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে যাবে। বাংলাদেশ লোক-কারুশিল্প কারুপল্লীতে হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক মাটির ঘর এখনও টিকে আছে। তবে সাধারণভাবে গ্রাম-বাংলা থেকে মাটির ঘর প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ১৯ নভেম্বর ২০১৯ /এমএম


Array