Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::  এক সময় মনে করা হতো ডায়াবেটিস বয়স্কদের রোগ; কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক তরুণ-তরুণীও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) তরুণ-তরুণীদের মাঝে এক ধরনের নতুন ডায়াবেটিসের সন্ধান পেয়েছেন। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার নিম্নআয়ের দেশগুলোর দরিদ্র কম বয়সিরা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। নতুন ধরনের এ ডায়াবেটিসের নাম দেওয়া হয়েছে ‘টাইপ ৫ ডায়াবেটিস’।

সম্প্রতি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিস কংগ্রেস ২০২৫ সালে নতুন ধরনের ডায়াবেটিসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।টাইপ ৫ ডায়াবেটিসে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ থেকে ২.৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত। এত বছর ধরে এ রোগটি চোখের সামনে থাকলেও সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। এক সময় এই রোগকে টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস ধরে চিকিৎসা করা হতো, অথচ বাস্তবে এটি একেবারেই আলাদা।

এ ধরনের ডায়াবেটিস বহুদিন ধরেই এশিয়া ও আফ্রিকার মতো অঞ্চলে দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু বিষয়টি ঠিকমতো বোঝা যায়নি এবং অনেক সময় টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস ভেবে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হতো; কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং গ্লোবাল ডায়াবেটিস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বিজ্ঞানী ড. মেরেডিথ হকিন্সের গবেষণার মাধ্যমে রোগটি এখন আলাদাভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

টাইপ ৫ ডায়াবেটিস কী?

টাইপ ৫ ডায়াবেটিসকে অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিসও বলা হয়। এটি সাধারণত যারা দীর্ঘদিন (বিশেষ করে শৈশবে) ধরে অপুষ্টির শিকার তাদের মধ্যে দেখা যায়।

টাইপ ২ ডায়াবেটিস যেখানে স্থূলতা ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের (রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে) সঙ্গে সম্পর্কিত সেখানে টাইপ ৫ ডায়াবেটিসের মূল কারণ হলো অপুষ্টির কারণে অগ্ন্যাশয়ের সঠিকভাবে গঠন না হওয়া।আগে তিন ধরনের ডায়াবেটিসকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এগুলো হলো টাইপ ১ ডায়াবেটিস, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং প্রেগন্যানসি ডায়াবেটিস।

টাইপ ১ ডায়াবেটিসকে অটোইমিউন রোগ বলা হয়। অগ্ন্যাশয়ে অবস্থিত ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে যখন মানুষের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়, চিকিৎসকরা এ অবস্থাকে বলছেন টাইপ ১ ডায়াবেটিস।

টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ে অবস্থিত ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তবে শরীর ইনসুলিন গ্রহণে বাধা দেয়। তাই টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা অত্যধিক হারে বেড়ে যায়।

টাইপ ৫ ডায়াবেটিসের সঙ্গে টাইপ ১ ও টাইপ ২-এর বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর শরীর ইনসুলিনের প্রতি সাড়া দিতে পারে না। তবে টাইপ ৫ রোগে আক্রান্তদের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা অত্যন্ত কম থাকে, তবে তাদের শরীর ইনসুলিনের প্রতি সাড়া দিতে পারে।

অনেক সময় টাইপ ৫ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ইনসুলিন ইনজেকশনের প্রয়োজন হয় না, মুখে খাওয়ার ওষুধেই চিকিৎসা সম্ভব। এর ফলে কম আয়ের দেশের জন্যও এর চিকিৎসা সহজ ও সাশ্রয়ী; যা এই রোগের মন্দের ভালো দিক।

ডায়াবেটিস মোকাবেলার নতুন দিগন্তের উন্মোচন

টাইপ ৫ ডায়াবেটিসকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় আইডিএফ সভাপতি পিটার শোয়ার্জ বলেন, টাইপ ৫ ডায়াবেটিসকে স্বীকৃতি দেওয়া একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন, যা বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস মোকাবেলার কৌশলে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। বহু বছর ধরে এই রোগ উপেক্ষিত ছিল, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

বর্তমানে এই নতুন রোগটি মোকাবেলা করার জন্য ‘টাইপ ৫ ডায়াবেটিস ওয়ার্কিং গ্রুপ’ নামে একটি দল গঠন করা হয়েছে। দলটি এই নতুন ধরনে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য স্পষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করবে। পাশাপাশি তারা একটি বৈশ্বিক গবেষণা ডেটাবেস তৈরি করবে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ মডিউল চালু করবে।

বিশ্বজুড়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষ টাইপ ৫ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের বেশিরভাগই এশিয়া ও আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলের বাসিন্দা; কিন্তু দশকের পর দশক ধরে এই রোগকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি বা ভুলভাবে অন্য ধরনের ডায়াবেটিস হিসেবে শনাক্ত করা হতো।

বিভ্রান্তি থেকে স্পষ্টতায়

ড. হকিন্স বলেন, তিনি প্রথম এ ধরনের রোগ সম্পর্কে ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময়।তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা আমাকে বলেছিলেন, তাদের বহু ডায়াবেটিস রোগী আছেন যাদের লক্ষণ টাইপ ১ ডায়াবেটিসের মতো দেখায়। এই রোগীরা তরুণ ও শুকনা গড়নের; কিন্তু ইনসুলিন প্রয়োগ করলেও উপকার হচ্ছিল না, বরং অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। রোগীরা টাইপ ২ এর মতো স্থূলও ছিলেন না। ব্যাপারটি ছিল খুব বিভ্রান্তিকর।’

অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিস প্রথম লক্ষ্য করা যায় ১৯৫০-এর দশকে, তবে বিষয়টি কখনও বৈশ্বিক গবেষণার মূল ধারায় আসেনি। ১৯৮৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে একটি আলাদা রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ১৯৯৯ সালে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে সেই স্বীকৃতি ফিরিয়ে নেয়।

২০১০ সালে ড. হকিন্স গ্লোবাল ডায়াবেটিস ইনস্টিটিউট গঠন করেন এবং এই রোগ নিয়ে নিবিড় গবেষণা শুরু করেন। ২০২২ সালে ভারতের ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজের সহায়তায় পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, এই রোগীদের রক্তে ইনসুলিন মাত্রা খুব কম থাকে এবং এটি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সজনিত নয়; যা পূর্বে ভাবা হতো।

তিনি বলেন, এই আবিষ্কার আমাদের রোগটিকে বোঝা এবং চিকিৎসা করার পুরো পদ্ধতিই বদলে দিয়েছে।এখন বিশ্বজুড়ে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া, চিকিৎসার গাইডলাইন হালনাগাদ করা এবং রোগীদের চিকিৎসা সহজলভ্য করে তোলা এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।আইডিএফ প্রেসিডেন্ট শোয়ার্জ বলেন, ‘এটি সমতা, বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং জীবন বাঁচানোর একটি লড়াই।’

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২০ এপ্রিল ২০২৫ /এমএম


Array