প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা এবং তা দমনে কারফিউতে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করে সরকারের কাছে উত্থাপন করতে বলা হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির ধরন অনুযায়ী খাতভিত্তিক নীতি সহায়তা দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। রোববার বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনা হয়। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ভবনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে ব্যবসায়ীরা সহিংসতা ও কারফিউতে আর্থিক ক্ষতির ফিরিস্তি তুলে ধরেন। পাশাপাশি কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ পুনরুদ্ধারে নজর দিতে সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন তারা।বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সালমান এফ রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা বৈঠকে ৫টি সমস্যার কথা বলেছেন। প্রথমত : কনটেইনার জট ও বন্দর-শিপিং ডেমারেজবিষয়ক।
এ সমস্যা নিরসনে ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট, শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, কাস্টমস, এনবিআর ও নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। দ্বিতীয়ত : এনবিআরকেন্দ্রিক সমস্যা। সেগুলো সমাধানে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। তৃতীয়ত : ঋণ কিস্তি পরিশোধে বাড়তি সময় ও পুনঃতফশিলের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। সেই বৈঠকে ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। চতুর্থত : ইন্টারনেট। আজ (রোববার) ৩টা থেকে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট চালু হয়ে যাচ্ছে, ব্রডব্যান্ডও চালু হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা ভবিষ্যতে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে বিষয়ে বৈঠকে ভালো পরামর্শ এসেছে। পঞ্চম : নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তাই পর্যায়ক্রমে কারফিউ শিথিল করা হচ্ছে। মেট্রোরেল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালুর জন্য সরকার কাজ করছে। শনিবার জাপানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কথা বলেছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টেকনিশিয়ান আনার জন্য।
সালমান এফ রহমান বলেন, আজকের (রোববার) মধ্যে এফবিসিসিআইকে বিভিন্ন খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছে। সেটি পাওয়ার পর পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব। আসলে ক্ষতিটা বেশির ভাগ হয়েছে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়। ঢাকার বাইরে অন্য জেলায় ক্ষতি কম হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্বে কে কী বিশ্বাস করবে বা না করবে, সেটা তাদের বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও মিথ্যা কথা প্রচার করায় বহির্বিশ্বে যে ইমেজ সমস্যা হয়েছে, সেটা রিপেয়ার (পুনরুদ্ধার) করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ প্রতিটি খাতের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিজিএমইএ বলেছে, তাদের ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বিকেএমইএও তাদের ক্ষতির কথা জানিয়েছে। আজকের (রোববার) মধ্যে সব খাতের পূর্ণাঙ্গ হিসাব পেয়ে যাব। আগামীকাল (আজ) মন্ত্রিসভা বৈঠকে পাঠানোর জন্য চেষ্ট করব। সেটি না হলো ২-১ দিনের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করব। সুনির্দিষ্ট হিসাব বের করার কাজ চলছে। এরপর সরকারের সহায়তা চাওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো বিদেশি বায়ার অর্ডার বাতিল করেছেন-এ রকম কোনো তথ্য বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ থেকে পাওয়া যায়নি। এটা একটি গুজব বলে মনে করি। সাপ্লাই চেইনে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরসহ সব জায়গায় ম্যানুয়ালি কাজ হয়েছে।
এদিকে এফবিসিসিআই সূত্রে জানা যায়, কোন খাতে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, সেটি জানাতে এফবিসিসিআই থেকে বৈঠকে অংশ নেওয়া সব চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনকে রোববার চিঠি দেওয়া হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছে। হিসাব পেলে পূর্ণাঙ্গ হিসাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে।
ইমেজ পুনরুদ্ধারে তাগিদ : বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ ব্যবসায়ী নেতাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ পুনরুদ্ধারে নজর দিতে সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তরুণ জনগোষ্ঠীর মাঝে আস্থা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তা না হলে বাংলাদেশ থেকে মেধা পাচার বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
বৈঠকে উপস্থিত আইসিটি সেক্টরের এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, যখন বিদেশি বায়ারদের কাছে আমরা বলি ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে, তাই বাংলাদেশে ইন্টারনেট ডাউন ছিল ৭ দিন, এটা কেউ বিশ্বাস করছে না। তারা বলে, এত দুর্বল তোমাদের নেটব্যবস্থা। তখন তারা আমাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এভাবে বললে পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে আসবে না সেবা নিতে। তারা বলবে, তোমার দেশ এমন, তাহলে কেন ব্যবসা করব তোমাদের সঙ্গে। এর চেয়ে আমরা যদি বলি দেশে ইমার্জেন্সি হয়েছিল বিধায় নেট বন্ধ ছিল, এতে তারা কিছু মনে করে না।
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক ইমেজ ফিরিয়ে আনতে সরকার এবং ব্যবসয়ীদের ধারাবাহিকভাবে ইন্টারনেটের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট বার্তা দিতে হবে। এখন আমরা যে যার মতো বার্তা দিচ্ছি। আমরা যদি বলি, ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে, সার্ভার ডাউন হয়েছে-কেউ বিশ্বাস করছে না আমাদের। ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে, এর জন্য ইন্টারনেট বন্ধ-এ কথা বলা বাচ্চাসুলভ মনে হয় আজকের এই দিনে।
অপর এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বৈশ্বিক ইমেজ পুনরুদ্ধারে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ভেতরে তরুণ জনগোষ্ঠীকে আস্থায় নিয়ে আসতে হবে। এমনিতেই অনেক মেধাবি বিদেশে কাজের জন্য চলে যাচ্ছেন (ব্রেইন ড্রেন)। এখন তরুণরা বিমুখ হলে ভবিষ্যতে আমরা শিল্পে কর্মী পাব কীভাবে। কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ব। তিনি আরও বলেন, বিদেশে যে ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে, সেটা ফিরিয়ে আনতে সরকারের একটি উইং থেকে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে নিয়মিত ব্রিফ করতে হবে বিদেশিদের।
ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের আহ্বান জানিয়ে গাড়ির আমদানির সঙ্গে জড়িত এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে এখন পরিত্যক্ত ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখানে সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গাড়ির ফিটনেস, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশনসহ বিআরটিএ-এর দৈনন্দিন সেবাগুলো দেওয়া যাচ্ছে না। এটি কবে চালু হবে, সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিআরটিএ-এর সার্ভার কাজ না করলে গাড়ির ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশনের পরামর্শ দেন তিনি।
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৯ জুলাই ২০২৪ /এমএম