Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে। এতে ডলারের দাম বেড়েছে, কমেছে টাকার মান। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। ফলে টাকার হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ডলারের হিসাবে বাড়েনি, বরং কমে গেছে। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে ডলারে। ডলারে ঋণ কমায় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডও কম হয়েছে। অন্যদিকে বৈদেশিক দায়-দেনার পরিমাণ বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।

ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৈশ্বিক মন্দা শুরুর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়ন কর্মকাণ্ড ডলার ও টাকার হিসাবে সমান্তরাল গতিতে এগিয়েছে। মাঝেমধ্যে সামান্য একটু ওঠানামা করেছে, তবে বড় ধরনের কোনো বিচ্যুতি হয়নি। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে শুরু হয় বৈশ্বিক মন্দা। মার্চে এ মন্দা আরও প্রকট হয়। ওই মন্দার প্রকোপ এখনো রয়েছে, তবে তীব্রতা কিছুটা কমেছে। একই সঙ্গে মন্দার নেতিবাচক প্রভাব এখনো বিদ্যমান। ওই মন্দার কারণে বৈশ্বিকভাবে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। এতে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী ডলার না থাকায় বেড়েছে এর দাম। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকেই দেশে ডলারের সংকট শুরু হয়। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) নির্ধারিত ডলার বিক্রির সর্বোচ্চ দাম ১১০ টাকা। এ হিসাবে গত এক বছর ১১ মাসে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ টাকা বা ৩০ শতাংশ। কিন্তু বাফেদা ও এবিবির বেঁধে দেওয়া ওই দামে বাজারে ডলার পাওয়া যায় না। ডলার বিক্রি হচ্ছে গড়ে প্রায় ১২৬ টাকা করে। এ হিসাবে ডলারের দাম বেড়েছে ৪১ টাকা বা ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে নির্ধারিত দরে ৩০ শতাংশ এবং বাজার দরে ৪৮ শতাংশ। ২০২২ সালের মার্চের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে টাকার এই অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় এবং টাকার মান কমায় ডলারের হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, এর বিপরীতে টাকার হিসাবে বেড়েছে। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে টাকার হিসাবের পাশাপাশি ডলারের হিসাবকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ, আমদানি-রপ্তানি, বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ, পরিশোধসহ অনেক কর্মকাণ্ড ডলারে সম্পন্ন হয়। এছাড়া বড় ও মাঝারি শিল্পের ঋণের প্রায় অর্ধেক ব্যয় আমদানিতে, যা ডলারে সম্পন্ন হয়। আর রপ্তানি আয়ের পুরোটাই ডলারে সম্পন্ন হয়। যে কারণে ডলারের হিসাবে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমা মানেই হচ্ছে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের গতি কমেছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব থাকবে। বিনিময় হারের ওঠানামার কারণে পণ্যের দামও ওঠানামা করবে। ডলারের দাম কেবল বাড়তেই থাকলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেবে। রপ্তানিকারকরা ডলার যে কোনো মূল্যে ধরে রাখার চেষ্টা করবে বাড়তি দামের আশায়, একইভাবে আমদানিকারকরা কম দামে ডলার আগাম কিনে রাখবে। ফলে সংকট আরও বাড়বে। এ সংকট মোকাবিলায় ডলারের দামে স্থিতিশীলতা আনাটা জরুরি। ডলারের দাম বেপরোয়া গতিতে বাড়তে থাকলে টাকা ও ডলারের হিসাবে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের প্রবৃদ্ধির ব্যবধানও বেড়ে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে টাকার হিসাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। কিন্তু ডলারের হিসাবে এ খাতে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি। উলটো সামান্য নেতিবাচক হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে টাকার হিসাবে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। কিন্তু ডলারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়নি। তা ছিল নেতিবাচক।

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ডলার ও টাকার হিসাবে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। ওই বছরের মার্চের পর থেকে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ডলারের হিসাবে কমতে থাকে এবং টাকার হিসাবে বাড়তে থাকে। একই বছরের মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ডলারের হিসাবে ছিল ১০ দশমিক ১ শতাংশ এবং টাকার হিসাবে ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। জুনে ডলারের হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং টাকার হিসাবে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। একই বছরের সেপ্টেম্বরে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ডলারের হিসাবে কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং টাকার হিসাবে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ। এর পর থেকে টাকা ও ডলার-দুই হিসাবেই ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা বেসরকারি খাতে চাহিদা কমায় ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে টাকার হিসাবে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। কিন্তু ডলারের হিসাবে তা নেতিবাচক।

২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানি খাতে ঋণের প্রবাহ ডলার ও টাকার হিসাবে সমান্তরাল গতিতে বাড়ছিল। তবে প্রবৃদ্ধির হার বাড়া-কমার ক্ষেত্রে সামান্য ওঠানামা করলেও খুব কাছাকাছি ছিল। কিন্তু ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দুই খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির ব্যবধান বাড়তে থাকে। অর্থাৎ ডলারের হিসাবে কমতে এবং টাকার হিসাবে বাড়তে থাকে। টাকার মান কমায় এবং ডলারের দাম বাড়ার কারণে এমনটি হয়েছে।

২০২১ সালের জুনে আমদানি-রপ্তানিতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল টাকায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ডলারে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর থেকে এ ব্যবধান বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত এ ব্যবধান প্রায় ২ শতাংশ বেড়ে ডলারে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১৬ শতাংশ; কিন্তু টাকার হিসাবে প্রায় ১৮ শতাংশ। এরপর থেকে ডলারের দাম বেশি মাত্রায় বাড়ায় এ হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে এবং টাকার হিসাবে বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের জুনে টাকার হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ; কিন্তু ডলারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে যায়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে টাকায় ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে সামান্য কমে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৮ শতাংশে এবং ডলারের হিসাবে কমে প্রবৃদ্ধি দশমিক ১ শতাংশ নেতিবাচক হয়ে যায়। ডিসেম্বরে এ খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও কমে টাকায় ১৬ শতাংশ এবং ডলারে দশমিক ৯ শতাংশ নেতিবাচক হয়ে পড়ে। গত বছরও এ খাতে ডলারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি কমে নেতিবাচক ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। তবে টাকার হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশ।

২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয়জনিত ব্যয় খুব কাছাকাছি ছিল। তবে বিভিন্ন সময়ে সামান্য ওঠানামা করেছে। ২০২১ সালের শুরু থেকে করোনার সংক্রমণ কমার কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিক হতে থাকে। ফলে চাহিদা বেড়ে যায়। এতে বিশ্ববাজারে পণ্যের দামও বাড়তে থাকে। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয় ও সমন্বিত মূল্যজনিত ব্যয়ের ব্যবধানও বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে পণ্যের দাম আরও বাড়তে থাকায় এ ব্যবধানও বাড়তে থাকে। অর্থাৎ পণ্যের দাম বাড়ার কারণে ১০০ ডলার দিয়ে ২০২১ সালের আগে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, ২০২১ সাল থেকে একই ডলারে অনেক কম পণ্য আমদানি হতো। ২০২১ সালের এপ্রিল-জুনে ডলারের হিসাবে আমদানি ব্যয় প্রায় ৭৩ শতাংশ বেড়ে যায়। কিন্তু পণ্যের দাম বৃদ্ধিজনিত বাড়তি মূল্য সমন্বয় করলে আমদানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পর থেকে আমদানি কম হওয়ায় ডলারের হিসাবে আমদানি ব্যয় কমেছে; কিন্তু মূল্য সমন্বয় করলে নেতিবাচক হয়ে যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মূল্য সমন্বয়জনিত আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ওই বছরের মার্চে সমন্বয়জনিত প্রবৃদ্ধি ২৪ দশমিক ২ শতাংশ নেতিবাচক ছিল, অথচ ওই সময়ে ডলারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি ছিল ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ডলারের হিসাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে; কিন্তু পরিমাণে পণ্যের আমদানি কম হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার কারণে এ খাতের ব্যবধান কমেছে। তবে এখন ডলারের হিসাবেও আমদানি নেতিবাচক এবং পণ্যের পরিমাণগত হিসাবেও নেতিবাচক। ডলারের হিসাবে গত অর্থবছরে আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে কমেছে ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ। পণ্যের পরিমাণগত দিক থেকে আমদানি আরও বেশি কমেছে।

প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ /এমএম