Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌  জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। গণপরিবহন থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সহ সবকিছুর দামই বাড়তির দিকে। জনজীবন এক দুর্বিষহ চাপে বিপর্যস্ত। এমন অবস্থায় সংকট নিরসনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ফের জ্বালানি তেল আমদানীতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।বিপিসি পরিচালক এ বি এম আজাদ বলেন, ‘আমরা আপাতত ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) আমদানী করতে চাই। পরিশোধিত তেল আমদানীতে খরচ বেশি পড়ে। সেক্ষেত্রে ক্রুড অয়েল কিছুটা কম খরচে আমদানী করা যায়।’

দেশে আসা অপরিশোধিত তেল রিফাইনারীতে পরিশোধিত হয়ে বাজারজাত হয়। দেশে অবস্থিত ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেডের (ইআরএল) তেল পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন। যা চাহিদার তুলনায় বেশ কম। ইস্টার্ণ রিফাইনারীর সক্ষমতা বাড়তে কাজ চলছে বলে এ বি এম আজাদ বলেন, ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রত সময়ের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। এ ইউনিট নির্মিত হলে তেল পরিশোধনের সক্ষমতা গিয়ে দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টনে। যা আমদানি খরচের চাপ অনেকটাই কমিয়ে দেবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিৎ রাষ্ট্রীয় সংস্থার ওপর নির্ভর না করে ব্যক্তি খাতে জ্বালানি তেলের অনুমতি দেয়া। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, পরিবর্তন আসবে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে। এলপিজি গ্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতকে জড়িত করার পর নৈরাজ্য অনেকটাই কমে এসেছে।জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন যে, বিপিসিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, বিপিসির পিঠ এখন দেওয়ালে গিয়ে ঠেকায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। বিপিসি তেল আমদানি বন্ধ করতে প্রায় বাধ্যই হচ্ছিল। মূল্য সমন্বয় করা ছাড়া হাতে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা যায়, গত ছয় মাসে (ফেব্রয়ারি-জুলাই) বিপিসির লোকসান আট হাজার কোটি টাকা। এ সময় দৈনিক লোকসান গুণতে হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। লোকসান ঠেকাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়।বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও বিপিসির লোকসানের অঙ্ক দেখিয়ে বৃহস্পতিবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। ৯ মাসের বিরতিতে তেলের দাম গড়ে ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত প্রতি বিপিসি মুনাফায় ছিল। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মে (২০২২) পর্যন্ত বিপিসি মুনাফা করেছে এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) গত ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মে পর্যন্ত তেল বিক্রি করে লোকসান দেয়নি। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ছিল ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসে তেল বিক্রি করে বিপিসি নিট মুনাফা করেছে এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

গত ৯ জুন অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২’ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে বিপিসি তেল বিক্রি করে মুনাফা করা শুরু করে। সে বছর প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১২৬ কোটি আট লাখ। এর পরের অর্থবছর ২০১৫-২০১৬ তে মুনাফা করেছে ৯ হাজার ৪০ কোটি ৭ লাখ টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মুনাফা হয় ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

২০১৭-২০১৮ তে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৮-২০১৯ এ ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০২০ এ ৫ হাজার ৬৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২০-২০২১ মুনাফা করেছে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মে’২২ পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা হয় ১ হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে চলতি বছর মে পর্যন্ত সময়ে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভবান হয়েছে। এ সময় বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও সমন্বয় করা হয়নি।

মুনাফার মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ২০১৩ সালে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের মূল্য ৯৪ ডলার থেকে কমতে কমতে ২০১৬ সালে ৪০ ডলারের নিচে নেমে আসে। কিন্তু বিপিসির পক্ষ থেকে তারপরও দাম কমানো হয়নি। কেবল ২০১৬ সালের এপ্রিলে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৩ টাকা কমানো হয়েছিল। তবুও কম দামে তেল কিনে তা দেশের বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রির কারণে বিপিসি প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর ফলে আট বছরে বাজেট থেকে বিপিসিকে তেল কেনা বাবদ কোনো ধরনের ভর্তুকিও দিতে হয়নি। চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটেও তেল কেনা বাবদ বিপিসির নামে কোনো ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়নি।

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে প্রতিব্যারেল ৯৪ দশমিক ১২ ডলারে নামে। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যা সবচেয়ে কম দাম। কিন্তু তখনই দেশের বাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়।গত ছয় মাসের তেল বিক্রিতে বিপিসির মোট ৮ হাজার ১৪.৫১ কোটি টাকা পরিচালন লোকসানকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তেলের মূল্য ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়িয়েছে– যা ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

দাম না বাড়িয়ে এই হারে লোকসান করতে থাকলেও– মুনাফার টাকায় প্রায় ২১ মাস জ্বালানি সরবরাহ করতে পারতো বিপিসি।বিপিসির তথ্যানুসারে, ২০১৮ অর্থবছর থেকে সংস্থাটি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে দিয়েছে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা।অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুসারে, নিয়মিত পরিচালন খরচ এবং অন্যান্য কর দেওয়ার পরও বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে বিপিসির রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যমান আমানতের টাকা দিয়ে আরো ১৪ মাস তেল সরবরাহ করতে পারতো বিপিসি।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের তথ্যমতে বিপিসির তিনটি বিতরণকারী কোম্পানি- পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লি মিটেড ও যমুনা অয়েল কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে। এই আমানত দিয়ে আাগের দামে আরো পাঁচ মাস তেল বিক্রি করতে পারতো কোম্পানিগুলো।

বিপিসির এ লোকসান এবং জ্বালানী তেলের দাম স্বাভাবিকের বিষয়ে ইউএনডিপি বাংলাদেশ প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বিপিসি যে পুরো টাকাটাই লাভ করেছে তা নয়। বিপিসির বিভিন্ন ব্যাংকের নিকট তাদের লোন পরিষোধ করেছে। এছাড় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে টাকা ব্যয় করেছে। প্রশ্ন আসতে পারে, যে বিশ্ববাজারে যখন দাম কম ছিলো, তখন বিপিসি কেন দাম কমায়নি। এটা তাদের অদক্ষতার ও ব্যর্থতা উদাহরণ।তিনি আরো বলেন, তবে চলমান পরিস্থিতিতে ডিজেলের দাম এতোটা না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বাড়াতে পারতো। বিপিসির যদি উচ্চদামে তেল কেনা অব্যাহত রাখতো, তাহলে রিজার্ভে চাপ পড়তো। তাই এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সামনে কি হবে তা এখনি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কারণ এর সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় জড়িত।

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৯ আগস্ট ২০২২ /এমএম