Menu

প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক ::‌ সাধারণ মানুষের অস্বস্তির অন্ত নেই। কেউ কেউ ভুগছেন ক্ষুধার চাপে। যার ক্ষুধা নেই, তিনি ভুগছেন মানসিক চাপে। সেই মানসিক চাপ রাজনৈতিক হতে পারে, আবার সাম্প্রদায়িকও হতে পারে। বাজারে দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বাড়ছে। এ সময়েই সরকার ডিজেলের দাম আরেক দফা বাড়িয়ে বাজারের উত্তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। এর সঙ্গে করোনার ভয়াবহতা তো আছেই। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় মেনে নিয়েই এগিয়ে চলেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সেক্ষেত্রে আমাদের রপ্তানি আয় স্বস্তিদায়ক। গত কয়েক বছর ধরেই রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনকভাবে এগিয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমাদের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। পরবর্তী বছরে ১৫ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলারে। আশা করা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরে রাপ্তানি প্রবৃদ্ধি গেল অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আয়ের পরিমাণ হবে ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার।

আমাদের চলতি অর্থবছর শুরু হয়েছে জুলাই মাস থেকে। সে হিসাবে অক্টোবর পর্যন্ত ৪ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই ৪ মাসে মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বছর শেষে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির মাত্রা প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। স্বস্তির বড় কারণ হলো করোনার ভয়াবহতা কমে আসা। বছরের চলতি প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে এসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুনে ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। করোনার পুনঃআক্রমণেই তা হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৪৭ কোটি ডলার, যা আগস্ট মাসে এসে দাঁড়ায় ৩৩৮ কোটি ডলারে। সেপ্টেম্বরে এসে রপ্তানি হয় ৪১৭ কোটি ডলার, যা ছিল দেশের ইতিহাসে যে কোনো মাসে রপ্তানির সর্বোচ্চ পরিমাণ। অক্টোবরে এসে সেই রেকর্ড ভেঙে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৭২ কোটি ডলারে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানিতে প্রধান ভূমিকায় ছিল পোশাক খাত। মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি অবদান পোশাক খাতের। অক্টোবর মাসে এ খাতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৫৬ কোটি ডলার। এটি পোশাক খাতের এক মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে যে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে পোশাক খাতের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। পোশাক খাতের ভেতর আবার নিট পোশাক এগিয়ে। গত ৪ মাসে নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৭২০ কোটি ডলারের। আর ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৪১ কোটি ডলারের। যদি আমরা ২০২০-২০২১ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে একই সময়ে এ বছর নিট পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশ আর ওভেন পোশাক রপ্তানিতে ১৬ শতাংশ।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যুরো গত ২ নভেম্বর রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, তৈরি পোশাকের পাশাপাশি হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৬ কোটি ডলার, যা এ বছর হয়েছে ৪৬ কোটি ডলার। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ। গেল বছর এ সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৮ কোটি ডলার, যা চলতি বছরে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ডলারে। হোম টেক্সটাইল রপ্তানিও বেড়েছে সন্তোজনকভাবে। গত অর্থবছরে এই সময়ে এ খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৫ কোটি ডলার, যা চলতি অর্থবছরে হয়েছে ৪১ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধির হিসাবে এই অগ্রগতি প্রায় ১৭ শতাংশ। তবে এর পাশাপাশি স্বীকার করতে হবে, আমাদের একটি উল্লেখযোগ্য খাত হলো পাট ও পাটজাত পণ্য। এ খাতে গত বছর একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৩ কোটি ডলার। কিন্তু এ বছর পরিমাণ প্রায় ২৪ শতাংশ কমে গিয়ে হয়েছে ৩৩ কোটি ডলার। এটা মেনে নিয়েও বলা যায়, গত ৪ মাসে আমাদের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ছিল আশাব্যঞ্জক। গবেষকরা মনে করছেন, রপ্তানির প্রবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের আরও সক্রিয় ও অনুসন্ধানী হতে হবে। দেখতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব নতুন নতুন ক্রেতা আসছেন তারা কোন ধরনের পণ্য কিনতে আগ্রহী। তাদের চাহিদার নিরিখে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে মনোযোগ দিতে হবে। সে জন্য অভ্যন্তরীণভাবে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। ব্যবসা সহজীকরণকে আমলে নিতে হবে।

শুরুতেই বলেছিলাম, আমরা স্বস্তিতে নেই। যদিও বা কোনো স্বস্তি আসে, তা আবার অস্বস্তিকে সঙ্গে নিয়েই আসে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ভাগে আমাদের রপ্তানির খবরটি ছিল স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রবাসী আয়ের দিকটি হলো অস্বস্তিদায়ক। অর্থবছরের শুরুতেই প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমাদের মোট প্রবাসী আয় ছিল ১ হাজার ৮০৩ কোটি ডলার। গত বছর, ২০২০-২১ সালে করোনার আঘাত সত্ত্বেও প্রবাসী আয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ৩৬ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ওই আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই তা কমতে থাকে। অর্থবছরের শেষ মাস অর্থাৎ জুনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১৯৪ কোটি ডলার। এর পরের মাস অর্থাৎ নতুন অর্থবছরের জুলাইয়ে তার পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৮৭ কোটি ডলারে। এর পরের মাস আগস্টে এর পরিমাণ আরও ৩ শতাংশ কমে ১৮১ কোটি ডলার হয়েছে। গত বছরের আগস্টের তুলনায় এই পরিমাণটি প্রায় ৮ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বর মাসে এসে প্রবাসী আয়ের ধাক্কাটা অনেক বড় হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। অথচ গত বছরের সেপ্টেম্বরে পরিমাণটা ছিল ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে আয় কমে যাওয়ার পরিমাণটা প্রায় ২০ শতাংশ। এই কমে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে প্রভাবিত করবে।

কেন প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো করোনার ভেতরেও কেন তা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল। সরকার এবং আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রচার করছিলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর কারণে সরকার যে ২ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে, প্রবাসী আয় বাড়ার এটিই একমাত্র কারণ। কিন্তু ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রণোদনার বিষয়টি একটি কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। প্রকৃত সত্য হলো, করোনার সময় সারা বিশ্বে বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। এই বিমানই হচ্ছে বাইরের টাকা দেশে পাঠানোর অবৈধ পথ। সে পথ বন্ধ থাকার ফলে বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলেই অর্থের প্রবেশ ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে দেশে বিমান যোগাযোগ শুরু হওয়ায় অবৈধ পথটিও খুলে গেছে। তাই আমাদের ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ কমে গেছে, যে কারণে আগামী দিনগুলোতে তা আরও কমতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তাই নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রবাস বাংলা ভয়েস/ঢাকা/ ০৯ নভেম্বর  ২০২১ /এমএম