প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: ‘ডোন্ট গ্রো আপ, ইটস অ্যা ট্র্যাপ’ নামে জোনাহ লেক-এর একটা গান আছে। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ শিরোনামে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমেরও আছে একটা গান। নামেই বুঝতে পারছেন গানের মর্মার্থ। এসব গান শুনলেই আমাদের হারিয়ে যেতে হয় অতীতে। মনে পড়ে যায় পুরনো কোনো স্মৃতি। তখন স্মৃতি রোমন্থনে সবসময়ই বর্তমানের চেয়ে অতীতের কাটানো সময়কেই রাখা হয়।
স্মৃতিবিজড়িত এসব গানের মধ্যে আজকের কোনো যুবক যেমন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পান, তেমনি অনেক বৃদ্ধও এর মাঝে তাদের অনুভূতি খুঁজে পান। হলফ করে বলা যায়, গানের সব কথার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক খুঁজে না পেলেও আজকের শিশুরা বড় হলে এই কথাগুলোর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবে তাদের সোনালি অতীতের।
ভ্রমণে ভীষণ ক্লান্তি কাজ করে?ভ্রমণে ভীষণ ক্লান্তি কাজ করে?
অতীত যে বর্তমানের থেকে সুন্দর ছিল তা শুধু এসব গানে নয়, যুগ যুগ ধরে অনেক কবি ও শিল্পী তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আপনি এখন শাহ আবদুল করিমের গানেই বলুন আর পিঙ্ক ফ্লয়েডের হাই হোপস-এর কথাই বলুন, এই অতীতের প্রতি কাতরতা সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি লক্ষণীয়। একদিকে বর্ষায় গাজির গানের কথা ভেবে শাহ আবদুল করিম যেমন আনন্দের স্মৃতিতে কাতর, অন্যদিকে, পিঙ্ক ফ্লয়েডের ডেভিড গিলমোর অতীতের সবুজ ঘাস, আলো যেগুলো বর্তমানের থেকে সবুজতর, উজ্জ্বল ছিল ভেবে বিষণ্ন হন। এ যেন এক বিশ্বজনীন মানব উপলব্ধি, যা যুগ যুগ ধরে ছিল এবং ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।
পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে বসলে, আলোচনাগুলো বেশির ভাগ সময় দেখা যায় অতীতের দিকে চলে যায়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অতীতের স্মৃতিময় দিনগুলোর আলোচনা করে আনন্দ পাই। সেগুলোর কিছু গল্প হয়তো দুঃখের অথবা সুখের, কিন্তু তবুও আগের দিনগুলো সবসময়ই আমাদের মনে একটি বিশেষ অবস্থানে থাকে। তাই ভবিষ্যৎ বা বর্তমান যেমনই হোক না কেন, ‘সোনালি দিনগুলো’ কেবল অতীতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়।
একটি উদাহরণ টানা যায়, হাইস্কুলে থাকতে হয়তো শৈশবের কথা ভেবে মনে হতো প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলো আরও সহজ, সুন্দর ছিল। মনে হতো শৈশবের সেসব স্মৃতিই মজাদার ছিল। তখন হাইস্কুলের নানারকম চিন্তাভাবনাই মনে হতো কঠিন, আগেরগুলো সহজ। আবার কলেজে মনে হতো, হাইস্কুল অনেক সহজ ছিল। সেই দিনগুলো অনেক আনন্দের। আর এই পিছুটানের চক্র সারা জীবনই চলতে থাকে আমাদের।
এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরিক্ষেত্র যত ধাপই অতিক্রম করি-না কেন, আগের স্মৃতি সবসময়ই সহজ ও আনন্দময় বলে অনুভূত হয়। অথচ, যখন জীবনের ওই সময়গুলো পার করছিলাম, তখন সেই সময়ের থেকে কঠিন সময় কখনোই যেন পার করিনি বলে মনে হতো। জীবনের সব ধাপেই বর্তমান নয়; বরং অতীতকে বেশি সোনালি মনে হতো। অতীতেই যেন সবকিছু সহজ ও সুন্দর ছিল।
কিন্তু কেন অতীতকে বর্তমানের চেয়ে ভালো মনে হয়? এর পেছনে কোনো মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে কি? ১৯৮৮ সালে জার্নাল অব পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজির একটি গবেষণাপত্রে টরি হিগিন্স এবং চার্লস স্ট্যাঙ্গোরের গবেষণায় এ ঘটনা ঘটার পেছনে একটি সম্ভাবনা উঠে আসে। উদাহরণস্বরূপ, যখন মানুষ বলে যে কোনো একটি কনসার্ট চমৎকার, তখন তারা বোঝায় যে এটি সেই সময় পর্যন্ত তাদের দেখা অন্যসব কনসার্টের তুলনায় চমৎকার।
টরি হিগিন্স এবং চার্লস স্ট্যাঙ্গোর যুক্তি দেন যে, মানুষ যখন অতীতের ঘটনাগুলো সম্পর্কে চিন্তা করে, তখন তারা সেই ঘটনার মূল্যায়নটি শুধু মনে রাখে; কিন্তু সেই মূল্যায়নের কারণটি নয়। অর্থাৎ, ঘটনাটি কি তাদের কাছে ভালো ছিল নাকি মন্দ ছিল, সেটুকুই মনে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ হাইস্কুলে পড়া একটি কনসার্টের কথা চিন্তা করে, তাদের মনে আছে যে তারা মনে করেছিল কনসার্টটি চমৎকার; কিন্তু ভুলে যায় যে তাদের এই রায়টির ভিত্তি ছিল হাইস্কুল পর্যন্ত দেখা সমস্ত কনসার্টের ভিত্তিতে। যদি তারা সেই একই কনসার্ট একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে দেখে, যখন তাদের অভিজ্ঞতা বেশি, তাহলে তারা হয়তো ভাববে না যে, কনসার্টটি এত বেশি চমৎকার।
এ জন্য, আগে কোনো একটি ঈদ, পূজা, নববর্ষ বা কোনো উৎসব আমাদের কাছে যত চমৎকার লাগত, তা ছিল সেই বয়স পর্যন্ত উদ্যাপন করা অন্যসব উৎসবের সাপেক্ষে চমৎকার। যার ফলে স্বল্প অভিজ্ঞতার দরুন, উৎসবগুলোর মূল্যায়ন আমাদের কাছে ছিল অনেক বেশি, আর আমরা সেই মূল্যায়নটিই শুধু মনে রেখেছি।
আমরা যখন আমাদের জীবনের অতীতের ঘটনাগুলোর দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমরা অনেক কিছু চমৎকার বা অসাধারণ বা উজ্জ্বল হিসেবে মনে রাখতে পারি। শুধু ভুলে যাই যে আমরা কীভাবে সেই ঘটনাগুলো শ্রেষ্ঠত্ব বা উজ্জ্বলতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে অভিজ্ঞতার বিস্তৃত ভিত্তির সঙ্গে, আমাদের সত্যিকার অর্থে অনেক আনন্দিত, চমকপ্রদ হতে অনেক বেশি উত্তম কিছুর প্রয়োজন হয়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন জিনিসগুলো বেশি ভালো ছিল।
এরপর আরেকটি বিষয় হচ্ছে সময়ের পার্থক্য। বেশ খানিকটা গবেষণায় দেখা যায়, আমরা সুদূর অতীতের কথা অনেক বেশি বিমূর্তভাবে ভাবি, যেখানে বর্তমানের কথা অনেক স্পষ্ট আর সূক্ষ্মভাবে ভাবতে হয়। এ মুহূর্তে ঘটছে এমন অনেকগুলো ঘটনার সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরক্তির অনুভূতি জড়িত, যা আপনাকে দৈনন্দিন জীবনে চলাচল করার জন্য মোকাবিলা করতে হবে। যেমন: সামনে কোনো পরীক্ষা, বিল পরিশোধ করা, কাপড় ধোয়া বা ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদি আরও দৈনন্দিন বিষয়-আশয়। অন্যদিকে, যখন আপনি অতীত সম্পর্কে চিন্তা করেন, তখন এসব ক্ষুদ্র বিরক্তিগুলোর কথা মনে আসে না। আপনি যা ভাবেন তা হলো আপনার কাটানো দুর্দান্ত, মনে রাখার মতো সময়গুলো।
অন্যদিকে যখন আপনি অতীতের ঘটনাগুলোর দিকে ফিরে তাকান, আপনি জানেন যে সেগুলোর পরিণতি কী হয়েছিল। মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, কোনো ঘটনায় অনিশ্চয়তা আমাদের মনে চাপ সৃষ্টি করে। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা কাজ করে যখন আমরা কোনোকিছু সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকি, যখন জানি না যে কোনো ঘটনার ফলাফল কোনদিকে মোড় নেবে। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও খারাপ সময় কেটে গেলে অনেকটাই সয়ে আসে, যখন আমরা এর ফলাফল সম্পর্কে অবগত। এ জন্য বর্তমান প্রায়ই অতীতের চেয়ে কম আনন্দদায়ক মনে হয় আমাদের। কারণ, আমরা প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছি কীভাবে কী ঘটবে, তা এবার পরীক্ষার ফলাফলই হোক বা কোনো চাকরির ইন্টারভিউ।
স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ৭ কৌশল স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ৭ কৌশল
যখন আপনার অতীতের কথা চিন্তা করেন, আপনি পরবর্তী সময়ে কী ঘটতে চলেছে তার সম্পূর্ণ অনুভূতি সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে সেদিকে ফিরে তাকান। আপনি বন্ধুদের সঙ্গে কিছু মজার সময় বা একটি পেশাদারি সাফল্যের দিকে ফিরে তাকালে এবং সেই মজার সময়গুলোর কথা স্মরণ করলে নিশ্চিতভাবে জানেন কোন ঘটনার পর কী ঘটেছে। কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে, আপনি এটি করতে পারবেন না। কারণ, জীবন অনেক ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা, অস্বস্তি এবং চাপে পূর্ণ।
আমাদের জীবনে, আমরা নিশ্চয়তা আকাঙ্ক্ষা করি। কিন্তু কেউ শতভাগ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের বলতে পারবে না যে কখন কী ঘটবে। কিন্তু আমাদের এই অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হয় বর্তমানে প্রতিনিয়ত, যার কারণে অতীতের নিশ্চয়তা অনেকটাই সুখকর।
আমাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অবাক হওয়ার জন্য ঘটনার অনন্যতাও অধিক লাগে।অতীতে যখন আপনি বয়সে ছোট এবং অভিজ্ঞতায় কম, তখন প্রথমবারের মতো অনেক বিষয় অনুভব করা নিত্য-বিষয় এবং সেই প্রাথমিক অভিজ্ঞতা আপনার জীবনে পরবর্তী অভিজ্ঞতাগুলোর জন্য একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয়। প্রথম অভিজ্ঞতা সবসময়ই অনন্য এবং অদ্বিতীয়; বিশেষ এই অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করলে পরবর্তী জীবনে একই রকম অভিজ্ঞতাও ফিকে লাগে। যার ফলে আমাদের মনে এ অবস্থা একধরনের প্রত্যাশা তৈরি করে দেয়, যা আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার তুলনার দিকে ধাবিত করে।
তবে এর মানে কি এই যে, বর্তমান মুহূর্তগুলো আনন্দের নয়? না, বিষয়টি মোটেও তা নয়। বর্তমানও অতীতের তুলনায় বেশি আনন্দের হতে পারে। এর অর্থ শুধু এই যে, হয়তো আপনি বর্তমান মুহূর্তটিকে অতীতের সঙ্গে তুলনা করছেন, যা আপনাকে অতীতে হয়তো প্রথমবারের মতো একটু বেশিই অবাক করেছিল। অতীত কখনোই চাপমুক্ত ছিল না, যেমনটি ফিরে তাকানোর সময় মনে হয়। অন্যদিকে, বর্তমান অনেক সময়ই আপনি, যা অনুভব করছেন তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো হতে পারে অতীতের তুলনায়।
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ /এমএম