Menu

বাংলানিউজসিএ ডেস্ক :: মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রতারণার সঙ্গে মানুষ পরিচিত। এবার নতুন ধরনের এক প্রতারণার বিষয় ধরা পড়েছে। এটিকে বলা হচ্ছে ‘স্পুফিং’ (ধাপ্পাবাজি)। একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তির মোবাইল নম্বর হুবহু নকল করে কাউকে ফোন করা যায়। যার মোবাইলে ফোনটি আসছে, তিনি কোনোভাবেই বুঝতে পারবেন না ফোনটি আসল ব্যক্তি করেছেন, নাকি ‘স্পুফিং’ করে অন্য কেউ করেছেন। সারা বিশ্বে এটি ফান সফটওয়্যার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এই সফওয়্যারকে নানা ধরনের প্রতারণা, অর্থ আদায় ও জালিয়াতির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়েছে।

এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে মন্ত্রী, এমপি, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, পুলিশপ্রধানসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর ‘স্পুফিং’ করে, অর্থাৎ হুবহু একই নম্বর নকল করে সেখান থেকে কল করে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, বদলি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রের জন্য বড়ো হুমকি বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। কয়েক বছর ধরে সরকারের প্রশাসন তথা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইল নম্বরের হুবহু নম্বর থেকে কল করে তদবির করা হচ্ছে। কোথাও নেওয়া হয়েছে চাঁদা। চাকরির বদলি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে এ কাজ বেশি করা হচ্ছে। টেন্ডারবাজি বা ঠিকাদারির কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে ‘স্পুফিং’ নম্বর। কোথাও কোথাও সফল হলেও অনেক জায়গায় ধরা পড়েছে অপরাধীরা।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে, তার নাম ‘স্পুফিং’। এটি মূলত একটি মজা করার (ফান সফটওয়্যার) প্রযুক্তি। সারা বিশ্বে সাধারণত বন্ধুবন্ধব বা প্রিয়জনকে আচমকা ভড়কে দিয়ে স্রেফ মজা করার জন্যই এটি ব্যবহূত হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতারক চক্র এটিকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘সারা বিশ্বেই এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে মজা করার জন্য। এটি গুগলের প্লে স্টোরেই পাওয়া যায়। এটি আটকানোর কোনো ব্যবস্থা এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। কয়েকজন অপরাধী এই কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। তারপরও বিটিআরসি এ নিয়ে কিছু করা যায় কি না, সে ব্যাপারে চেষ্টা করছে।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের অস্বাভাবিক ফোনকল এলে প্রথমত বিচলতি না হয়ে স্বাভাবিক থাকতে হবে। এরপর কলটি শেষ করে ওই নম্বরে পুনরায় কল করে বিষয়টি যাচাই করে নিতে হবে। অথবা কল কেটে দিয়ে কল ব্যাক করতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু ফোনকলটি প্রযুক্তির সহায়তায় করা হয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই ফিরতি কলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যাবে। এরপরই বিষয়টি দ্রুত পুলিশকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে জিডিও করা যেতে পারে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার এ এফ এম আল কিবরিয়া  বলেন, ‘এটার সঙ্গে এখন মেইল আইডি হুবহু নকল করা হচ্ছে, এমন অভিযোগও আমাদের কাছে আসছে। পুরো বিষয়টি নিয়েই আমরা কাজ করছি। কীভাবে সমাধান বের করা যায়, সেই চেষ্টা চলছে।’

জানা গেছে, সরকারদলীয় একজন প্রভাবশালী নেতার নম্বর ‘স্পুফিং’ করে বছর দুয়েক আগে এক জায়গায় ফোন করে তদবির করা হয়। একজন প্রতিমন্ত্রীর এপিএসের নম্বর ‘স্পুফিং’ করে রংপুরের একটি থানার ইউএনওকে কল করে একটা তদবির করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তাও এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তখন শেরেবাংলা থানায় জিডি করলে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের সাবেক আইজি শহীদুল হকের মোবাইল নম্বর ‘স্পুফিং’ করে ডিএমপির এক ওসিকে ফোন করে প্রতারণা মামলার এক আসামিকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। পরে বিষয়টি ধরা পড়লে সেই আসামিকে আবার গ্রেফতার করা হয়।সম্প্রতি একজন সচিবের নম্বর ‘স্পুফিং’ করে চট্টগ্রামের একজন রেল কর্মকর্তার কাছে তদবির করা হয়েছে। এতে করে বিব্রত হচ্ছেন মন্ত্রী, এমপি ও সচিবেরা। অনেকেই এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে চিঠিও দিয়েছেন।

কয়েক মাস আগে টাঙ্গাইলের একজন সংসদ সদস্যের মোবাইল ফোন নম্বর ‘স্পুফিং’ করে দুটি উপজেলার সব ইউপি চেয়ারম্যানকে ফোন করা হয়। ফোনকারী সবাইকে অভিন্ন ভাষায় বলেন, ‘এটি এমপি সাহেবের নম্বর। তিনি এখন সচিবালয়ে আমার কক্ষে বসা আছেন। আমি ওনার ফোন থেকে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বলছি। আপনার ইউনিয়ন পরিষদের নামে শিগগিরই গম বরাদ্দ দেওয়া হবে। বেশি বরাদ্দ পেতে হলে কিছু টাকা বিকাশ করে দেন।’ এমপির নম্বর থেকে ফোন পাওয়ার পর প্রায় সব ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশে তাত্ক্ষণিক টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কেউ ১০ হাজার, কেউ আবার ২০ হাজার টাকা বিকাশ করেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ার পর মামলাও করা হয়। তবে সেই প্রতারককে শেষ পর্যন্ত ধরা যায়নি।

একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, দেশের মধ্য থেকে ‘স্পুফিং’ করে প্রতারণা করা কঠিন। দেশের বাইরে থেকে কেউ এই কাজ করতে পারেন। ঐ কর্মকর্তা বলেন, এটিকে অনেকে ভুল করে ‘ক্লোনিং’ বলছেন। আসলে ‘ক্লোনিং’ করতে হলে সিমের পুরো তথ্যই চুরি করতে হয়। এখানে সেটি করা হচ্ছে না। বিদেশ থেকে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফোন করা হচ্ছে প্রতারণা করার জন্য। এ ব্যাপারে কী করা যায়, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে। বিটিআরসির সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, একজন এমপির অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে তারা দেখতে পান, ১০ জনের একটি প্রতারক চক্র দেশব্যাপী এ ধরনের প্রতারণা করে চলেছে। যেসব বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহার করে টাকা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও শনাক্ত করেছে পুলিশ। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বিকাশ অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে এই চক্র প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

বাংলানিউজসিএ/ঢাকা/ ২৬ অক্টোবর ২০১৯/এমএম