প্রবাস বাংলা ভয়েস ডেস্ক :: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে শনিবার মধ্যরাত থেকে রোববার দিনভর ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন।
চবি মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক ডা. ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, আমরা প্রায় ১৫০০ জনকে সেবা দিয়েছি। প্রায় ৫০০ জনকে শহরে পাঠানো হয়েছে, এর মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ডা. মোস্তফা কামাল বলেন, ৮টা বাস ও ৯টা অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত: চবির দুই নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকা এক ছাত্রী শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাসায় ফেরেন। কিন্তু রাত গভীর হয়ে যাওয়ায় দারোয়ান তাকে বাসায় ঢুকতে বাধা দেন। একপর্যায়ে ছাত্রীকে মারধর করে বলে অভিযোগ ওই ছাত্রীর। খবর পেয়ে কিছু ছাত্র এসে ওই দারোয়ানকে ধরতে গেলে তিনি পালিয়ে যান। এ ঘটনা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে কিছু ছাত্র উত্তেজিত হয়ে দুই নম্বর গেট এলাকায় জড়ো হন।
তবে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কিছু নেতা অতি উৎসাহী হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন বলে অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীদের। পরে তারা দল বেঁধে ওই এলাকায় যান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ সময় দোকান ও বাড়ির জানালাসহ নানা স্থাপনা ভাঙচুর করেন শিক্ষার্থীরা। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা রাম দাসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এরপর দফায় দফায় ধাওয়া পালটাধাওয়া চলতে থাকে।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ পরিস্থিতি শান্ত করলেও রোববার বেলা ১১টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে ফের ধাওয়া পালটাধাওয়ায় জড়ায় দুই পক্ষ।
পুলিশ-প্রশাসনের বিতর্কিত ভূমিকা: রোববার উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও দুপুর পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি বলে অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীদের।
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) কামাল উদ্দিন রোববার দুপুর ৩টার দিকে চবির মেডিকেল সেন্টারের গ্রাউন্ড ফ্লোরে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কোন জগতে আছি! পুলিশ নাই, কোনো কিছু নাই। আমরা জিওসির সঙ্গে কথা বলেছি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে কথা বলেছি, দুই ঘণ্টা চলে গেলেও কেউ আসে নাই। পরে ১৪৪ ধারা জারির পর ৪টার দিকে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়।
আহত উপ-উপাচার্য ও প্রক্টর: স্থানীয়দের ধাওয়ায় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) কামাল উদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এছাড়া প্রক্টর তানভীর হায়দার আরিফ ইটের আঘাতে আহত হন ও পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে মেডিকেলে নেওয়া হয়। উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) শামীম উদ্দিন খানসহ নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মীরাও আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
রাজিউর রহমান নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে এক তলার ছাদ থেকে ফেলে দেয় স্থানীয়রা। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর তাকে উদ্ধার করা হয়। এক শিক্ষার্থীকে রামদা দিয়ে আঘাতের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এছাড়া ক্যাম্পাসের বাইরের বাসা ও মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের ঘরে ঢুকে মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
১৪৪ ধারা জারি: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, জনসাধারণের জীবন, সম্পদ রক্ষা ও শান্তি শৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে চবির দুই নম্বর গেট বাজার থেকে রেলগেট পর্যন্ত রাস্তার উভয়পাশে রোববার দুপুর ২টা থেকে সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৪৪ ধারার আদেশ করা হয়েছে।
এ সময় উল্লিখিত এলাকায় সব ধরনের সভা সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণজমায়েত, বিস্ফোরক দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র ইত্যাদি বহনসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় ৫ বা ততধিক ব্যক্তির একত্রে অবস্থান কিংবা চলাফেরা নিষিদ্ধ থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত: রোববার ও সোমবারের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) কামাল উদ্দিন বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোববারের সব পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সোমবারের স্থগিতাদেশ নিশ্চিত করেছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
অভিযোগের তীর বাগছাস নেতাদের দিকে: ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, শনিবার রাতে ও রোববার গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) কয়েকজন নেতা সমঝোতার দিকে না গিয়ে ছাত্রদের উসকানি দিয়ে স্থানীয়দের ওপর চড়াও হয়। ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম ফেসবুক লাইভে বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে সমঝোতা করে যখন চলে আসছিলাম, ঠিক তখনই বাগছাসের অতি উৎসাহী কিছু নেতাদের উসকানিতে ছাত্ররা ইট মারতে শুরু করেন। তাদের ছোড়া ইট উপ-উপাচার্য কামাল স্যারের হাতে লাগে।
এ ব্যাপারে চবি বাগছাসের আহ্বায়ক মুনতাসীর মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, পরিস্থিতিটাই এমন ছিল। কেউ উত্তেজিত ছিল, কেউ ম্যাচিউর আচরণ দেখিয়েছে। সব পরিস্থিতিতে সবাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে একপাক্ষিকভাবে একটা দলের ওপর অভিযোগ দেওয়া অনুচিত মনে করি।
তালা ভেঙে নিরাপত্তা দপ্তরের অস্ত্র নিলেন শিক্ষার্থীরা: রোববার দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে চবির নিরাপদ দপ্তর থেকে প্রায় ১০০ রামদা, কিরিচ নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সকাল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর অনুপস্থিতি ও জোবরা গ্রামে আটকেপড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে যাওয়ার জন্য এসব দেশীয় অস্ত্র নেন বলে দাবি শিক্ষার্থীদের।
নিরাপত্তা দপ্তরের সুপারভাইজার নূর উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, উপ-উপাচার্য কামাল স্যার, নিরাপত্তা প্রধানসহ আমরা তাদের অনেক বুঝিয়েছি। তবুও অনেকে না বুঝে তালা ভেঙে এগুলো নিয়ে গেছে। ৫ আগস্টের পর হল তল্লাশি করে ছাত্রলীগের ফেলে যাওয়া এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
ঘটনায় উসকানি দেওয়া বিএনপি নেতা বহিষ্কার: সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ তথ্য জানান।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ দলের নির্দেশনা অমান্য করে সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার কারণে গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী তাকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হলো।
রোববার এই নেতার বক্তব্যের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে চবি শিক্ষার্থীদের উচ্ছৃঙ্খল ও কুলাঙ্গার বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া এ ঘটনাকে ‘আন্দোলন’ উল্লেখ করে তা সফল করার আহ্বান জানান তিনি।
যৌথবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে পরিস্থিতি: ১৪৪ ধারা জারির পর রোববার বিকাল ৪টার দিকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাব। যৌথবাহিনীর অবস্থানের পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চবির নিরাপত্তা দপ্তরের সুপারভাইজার নূর উদ্দিন।
প্রবাস বাংলা ভয়েস /ঢাকা/ ৩১ আগস্ট ২০২৫ /এমএম